বিশ্বের জ্যোতিবিজ্ঞানের জ্যোতি বাংলার কেরানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র।

Radha-govinda-chandra

আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড মানমন্দিরের ডিরেক্টর বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হ্যারলো শ্যাপলি যশোহর জেলায় একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল “বিদেশ থেকে পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে আমরা যেসব পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য পেয়ে থাকি তার মধ্যে আপনার দান অন্যতম। আপনাকে আমরা আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।” চিঠিটির প্রাপক যশোহর জেলার কালেক্টরেট অফিসের একজন সামান্য কেরানী। যিনি, এমন কি তৎকালীন এন্ট্রাস পরীক্ষায়ও পাশ করতে পারেননি। কেরানীর নাম রাধাগোবিন্দ চন্দ্র।


জন্ম, কর্ম ও শিক্ষা:
যশোহর জেলার বকচর গ্রামে ১৬ই জুলাই ১৮৭৮ সালে রাধাগোবিন্দের জন্ম। তিনি যশোর জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলের গতানুগতিক পড়ালেখার চাইতে রাতের আকাশের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশী। স্কুল তাই শিকেয় উঠে। তৎকালীন সময়ে তিনি জিলা স্কুল হইতে এন্ট্রাস পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। ১৯০০ সালের দিকে ২২ বৎসর বয়সে যশোহর কালেক্টরেট অফিসের ১৫ টাকা বেতনের সামান্য কেরানির চাকরি গ্রহণ করেন।


রাধাগোবিন্দের জ্যেতির্বিজ্ঞান চর্চা যেভাবে শুরু:
শিশু বয়স থেকেই রাধা রাতের আকাশের সঙ্গী ছিলেন। তারারা তাঁকে ঘুম পাড়িয়েছে। তারারা তাঁর ঘুম ভাঙ্গিয়েছে। রাধা যখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন তাঁর পাঠ্যপুস্তক ছিল ‘চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ’। এই বইয়ে অক্ষয়কুমার দত্তের প্রবন্ধ ‘ব্রহ্মান্ড কি প্রকান্ড’ পাঠ করেই রাধাগোবিন্দ জ্যেতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা কি, গ্রহ কি, বিশ্বের সীমানা কি, এসব নানাবিধ প্রশ্ন তখন তাঁর মনে। তিনি তাঁর আত্নজীবনীমূলক পান্ডুলিপিতে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘অক্ষয় কুমার দত্তের চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়িয়া, নক্ষত্রবিদ হইবার জন্যে আর কাহারো বাসনা ফলবর্তী হইয়াছিল কিনা জানি না, আমার হইয়াছিল। সেই উদ্দাম ও উশৃঙ্খল বাসনার গতিরোধ করিতে আমি চেষ্টা করি নাই।”


১০ বছর বয়সে রাধাগোবিন্দ চন্দ্র যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় থেকেই বকচরের একতলা বাড়ির ছাদে সন্ধ্যার পর পরই রাধা আকাশ দেখা শুরু করেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এ কাজে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কেননা নক্ষত্র গ্রহ সম্পর্কে তাঁর খুব বেশী ধারণা ছিল না। এই সময় রাধার এক আত্নীয়’র বন্ধু এ্যাডভোকেট কালীনাথ এগিয়ে আসেন। কালীনাথের নেশা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা। তিনি এ সম্পর্কে ‘তারা’, ‘ভূগোলচিত্রম’ ও ‘পপুলার হিন্দু’ অ্যাস্টনমি’ নামে কয়েকটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। রাধা গ্রন্থগুলো পাঠ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করেন। এক পর্যায়ে কালীনাথ বাবুর কাছ থেকে একটি স্টার ম্যাপ ধার করে নিয়ে রাধা নক্ষত্রবিদ্যার অনুসন্ধান শুরু করেন। এরপর চিঠির মাধ্যমে রাধার সঙ্গে পরিচয় হয় শান্তিনিকেতনের ব্রাহ্মচর্যাশ্রমের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক জগদানন্দ রায়ের সঙ্গে। এ দু’ জনের মধ্যে আকাশ চর্চার যাবতীয় বিষয় চিঠিতে আলাপ আলোচনা হতো। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় জগদানন্দ রায় রাধার চিঠি মুদ্রণের ব্যবস্থা করতেন।

একান্তভাবে, নিজের চেষ্টায় বকচর গ্রামের ১৪ বছরের কিশোর রাতের আকাশের তারামন্ডলীকে চিনে ফেললো। কিন্তু নক্ষত্র চেনার কাজে দরকার প্রতি মাসের তারকা-ম্যাপ। দিনভর চাকরি আর রাত হলেই ধৈর্য্য ধরে আকাশ পর্যবেক্ষণ। এমনও রাত গেছে তিনি ঘুমাননি একটুও।


১৯১০ সালে রাধাগোবিন্দ চন্দ্র খালি চোখে হ্যালির ধুমকেতু পর্যবেক্ষণ করলেন অনেকদিন ধরে। অভ্যাসমত একটি খাতায় তিনি তার পর্যবেক্ষণ লিখে রাখতেন। খালি চোখে ধূমকেতু দেখেও রাধা তার যে রহস্য উন্মোচন করেছিলেন তা প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হতো। হ্যালির ধূমকেতু দেখার পরই রাধা ‘ধুমকেতু’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ধুমকেতু সম্পর্কে নানা পৌরাণিক আধুনিক ব্যাখ্যা ছাড়াও নিজের চোখে দেখা হ্যালির ধুমকেতু বিস্তারিত বর্ণনা করেন।

এ সব প্রবন্ধ পড়ে শান্ডি নিকেতনের বিজ্ঞান শিক্ষক জগদানন্দ রায় মুগ্ধ হয়ে চিঠি দিলেন রাধাগোবিন্দকে, পরামর্শ দিলেন একটি দূরবীণ সংগ্রহের। উৎসাহ ও বিভিন্ন সহযোগিতা পেয়ে ১৯১২ সালে জমি বিক্রি করে আর বেতনের টাকা জমিয়ে ২৭৫ টাকায় তিন ইঞ্চি ব্যাসের একটি ছোট্ট দূরবীণ কিনলেন।

এই দূরবীন হাতে পাওয়ার পর রাধার ঘুম হারাম হয়ে যায়। এভাবেই শুরু হল তার নতুন সাধনা। এবারের আগ্রহ-পরিবর্তনশীল তারা। রাতের আকাশে অনেক তারাই দেখা যায় যেগুলোর ঔজ্জ্বলা স্থির নয়। সময়ের সঙ্গে বাড়ে কমে। রাতের পর রাত অসীম ধৈর্যের সঙ্গে রাধাগোবিন্দ এই সব পরিবর্তনশীল তারা পর্যবেক্ষণ করতেন। সামান্য তিন ইঞ্চি দুরবীণ দিয়ে তিনি গড়ে তুললেন এক অমূল্য তথ্য ভান্ডার।

১৯১৮ সালের ৭ই জুন রাধাগোবিন্দ তিন ইঞ্চি ব্যাসের দূরবীণ দিয়ে আকাশের নতুন নক্ষত্র ‘নোভা’ আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেখান। এটি রাধার একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। তার এই আবিষ্কারের পরই নক্ষত্রের নামকরণ করা হয় ‘নোভা অ্যাকুইলা ত্রি ১৯১৮’। নোভা হচ্ছে কোন তারকার মৃত্যুকালীন অবস্থার বিষ্ফোরণ। সমগ্র এশিয়া মহাদেশে এই নোভা সর্বপ্রথম পর্যবেক্ষণ করার কৃতিত্ব একজন বাঙালির, তিনি হচ্ছেন আমাদের যশোরের কৃতি সন্তান রাধাগোবিন্দ চন্দ্র।

রাধার এই নোভা দর্শন সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ প্রবাসী পত্রিকাগুলোতে গুরুত্ব সহকারে ছাপে। নোভা সম্পর্কে রাধা তাঁর অভিজ্ঞতার কথাও লিখিতভাবে‘হারভারর্ড অবজারভেটরির’ পরিচালককেও অবহিত করেন। পরিচালক এডওয়ার্ড চার্লস পিকারিং রাধার চিঠি প্রাপ্তির পর তাঁকে নবগঠিত আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ ভ্যারিয়েবল স্টারস অবজারভাস (অ্যাভসো) সদস্য মনোনীত করেন। অ্যাভসোর সদস্য হওয়ার পর রাধা ভ্যারিয়েবল স্টার সম্পর্কে নতুন উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে আকাশচর্চা শুরু করেন। রাধা বহুরূপী তারার রহস্য উন্মোচন করে ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ৩৭ হাজার ২১৫টি ভ্যারিয়েবল স্টার সম্পর্কে তিনি অ্যাভসোকে তথ্য সরবরাহ করেছেন। এ কারণেই অ্যাভসোর ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত অনার রোলে ১০ হাজার ভ্যারিয়েবল স্টার সম্পর্কে পৃথিবীর যে ২৫ জন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী তথ্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে রাধার নামও লিপিবদ্ধ আছে। এছাড়া রাধার এই কাজের জন্য হারবারড অবজারভেটরির পরিচালক বিখ্যাত জ্যেতির্বিজ্ঞানী হারলো শ্যাপলির তাঁকে একটি প্রশংসাপত্র দিয়ে সাধুবাদ জানান। আমেরিকার অ্যাভসো ছাড়াও ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রনমিক্যাল এসোসিয়েশন, ফ্রান্সের লিয় অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা রাধার ভ্যারিয়েবল স্টার সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য সবসময় অপেক্ষা করে থাকতো। রাধাগোবিন্দের পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্য প্রকাশ পেতো এসব মানমন্দির প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় এবং তারই সূত্র ধরে তারা নতুন নতুন ভ্যারিয়েবল স্টার সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করতো।

রাধাগোবিন্দের সংগৃহীতের তথ্য সেই কালের ইউরোপ-আমেরিকার যে সব বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থাগুলো ব্যাবহার করতো তাদের মধ্যে রয়েছে-আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমন্দির, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ভ্যারিয়েবল স্টার অবজার্ভার, লন্ডনের ব্রিটিশ অ্যাস্টোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রান্সের লিয় মানমন্দির প্রভৃতি। হার্ভার্ডে এখনও তাঁর পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্য সযত্নে রক্ষিত আছে।


রাধাগোবিন্দের কাজের সাক্ষী:
বকচর এলাকার নতুন প্রজন্মের কেউই রাধাগোবিন্দকে চেনে না। প্রবীণরা গত হয়েছেন। সংখ্যালঘুদের কেউ কেউ ভারতে চলে গেছেন। অনেক খেঁজাখুঁজির পর জানা গেল শ্রীদাম বাবু রাধাগোবিন্দের সঙ্গে রাতের আকাশ দেখেছেন। তার বাড়ি রাধাগোবিন্দের বাড়ির সামনেই। বকচর এলাকার মন্দিরের পাশেই শ্রীদাম বাবুর বাড়ি। তার বয়স তখন ৯০ বছর। রাধাগোবিন্দ সম্পর্কে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন।

শ্রীদাম বাবু বলেন, “রাধাগেবিন্দ যশোর কালেক্টরেট অফিসের খাজাঞ্চি ছিলেন। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। সে সময় রাধা দাদা রাত জেগে তারা দেখতেন। তখন ঘন বসতি ছিল না। এলাকায় তিনটি সংস্কৃতি ক্লাব ছিল। সাহিত্য সম্মেলন, গানের অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। দাদা শিশুদের খুব ভালবাসতেন। আমাদের বাড়ির ছাদে টুলের ওপর দাঁড় করিয়ে দূরবীনে চোখ লাগিয়ে দিতেন। কতো তারা দেখেছি তার কোন হিসাব নেই। ভাদ্র মাসে আকাশ পরিষ্কার থাকলে তাঁর খাওয়া দাওয়া থাকতো না শুধুই রাতের আকাশ দেখা ছাড়া। পৃথিবীর ফাস্ট প্রাইজ তিনি পেয়েছিলেন। আমেরিকা সরকার তাঁকে দূরবীন উপহার দিয়েছিল। গোবিন্দ দাদা নিজেও জমি বিক্রি করে দূরবীন কিনেছিলেন। অবসর জীবনযাপনের সময়ও তিনি তারা দেখেছেন। পেনশনের টাকা তুলতে গেলে কালেক্টরেটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বাচসা হয়। কর্মকর্তারা তাঁকে ভারতে চলে যেতে বলেন। তখন ডিসি ছিলেন এম. আর কুদ্দুস। ১৯৬০ সালের দিকে হবে। গোবিন্দ মাইগ্রেশন চান। এক পর্যায়ে দূরবীন নিয়ে ভারতে যাত্রা করেন। বেনাপোলে তার দূরবীন কাস্টমস সিজ করে। পরে আমেরিকা, ফ্রান্সের সঙ্গে গোবিন্দ যোগাযোগ করেন। ডিসি বাড়ি এসে দূরবীনটি ফেরৎ দিয়ে যান। পরে গোবিন্দ দূরবীন নিয়ে ভারতে বারাসাতে গিয়ে বসবাস শুরম্ন করেন। স্বাধীনতার পর গোবিন্দের ছেলে কালু, মেয়ে বর্ষা বকচরে কয়েকবার এসেছিল। কিন্তু তাদেরকে কেউ সাহায্য করেনি। শ্রীদাম বাবু আরো জানালেন, ২০/২৫ বছর আগে ফ্রান্স থেকে একদল লোক এসেছিলেন ফ্রান্সে কনফারেন্স করার জন্য রাধাগোবিন্দকে নিতে। কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন। তারা ঠিকানা নিয়ে গেছেন। বাড়ীর ছবি তুলে নিয়ে গেছেন। আমরা কেউ তাকে স্মরণ করি না। তবে শুনেছি ভারতে তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উৎসবের উদযাপিত হয়।”

আব্দুল কাদেরের বয়স এখন ৮৮ বছর। তিনি বকচর এলাকার একজন প্রবীণ ব্যক্তি। রাধাগোবিন্দ চন্দ্র সম্পর্কে আব্দুল কাদের বললেন, “রাধা সারা রাত জেগে তারা দেখতো। আমরা মাঝে মধ্যে হাজারি ঠাকুরের বাড়ী থেকে রাধার আহবানে তারা দেখার জন্য যেতাম। কালেক্টরেট অফিসের খাজাঞ্চির চাকরি করে বাড়ী ফিরে সন্ধ্যা থেকেই রাধা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। বিলেত থেকে তাঁকে তারা দেখার জন্য দূরবীন দেওয়া হয়েছিল। আইয়ুব খানের আমলে রাধা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতে বারাসাতে চলে যায়। তারপর আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। শুনেছি রাধার বাড়ি রোকন দারোগা রিকুজিশন করে নিয়েছে। রাধা বকচরের গর্ব ছিল। কারো সঙ্গে জোরে কথা বলেনি। শুধু তারা দেখার কথাই বলেছে।”


কাজের স্বীকৃতি:
আমেরিকা ও ইউরোপের এই সব সংস্থাগুলো তাঁকে সম্মানিত সদস্য নির্বাচিত করেন। তার কাজের সুবিধার জন্য হার্ভার্ড মানমন্দির কর্তৃপক্ষ ১৯২৬ সালে সেই সুদূর আমেরিকা থেকে অ্যাভসো রাধার কাজের উৎসহ সৃষ্টির লক্ষ্যে সোয়া ছ’ইঞ্চি ব্যাসের আর একটি দূরবীরন যশোরের বকচর পল্লীর রাধাগোবিন্দ চন্দ্রকে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন। সেই সঙ্গে আসে মানমন্দিরের ডিরেক্টরের কৃতজ্ঞতাপত্র।

ফরাসি সরকার পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে, ১৯২৮ সালে ভারত উপমহাদেশের প্রথম বাঙ্গালি রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাধাগোবিন্দকে OARF (Officers Academic republican francaise) সম্মানসূচক উপাধি ও পদক প্রদান করেন। কলকাতায় ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারফত রাধাকে এই সম্মান জানানো হয়। এর আগে কোনো বাঙ্গালি ফ্রান্স সরকারের এমন সম্মান অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করেননি।

এখন আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রাধার কাজের সূত্র ধরে আকাশের নতুন নতুন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। তারার আলো, দূরত্ব, ঔজ্জ্বল্য পরিবর্তনের কারণ ছাড়াও সৃষ্টি রহস্যের নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারছেন।
     

ভুলে যাওয়া সহজ:
কোন রকম প্রথাগত ডিগ্রী ও প্রশিক্ষণ, জ্যোতিবিজ্ঞান গবেষণার জন্য উপযুক্ত মানমন্দির ও যন্ত্রপাতি, এই সব না থাকলেও কেবলমাত্র অদম্য কৌতুহল, ইচ্ছাশক্তি, নিষ্ঠা ও অপরিসীম অধ্যবসায়কে সম্বল করে যে উঁচুমানের বিজ্ঞান গবেষণা করা সম্ভবপর রাধাগোবিন্দ তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আজ খুব দুঃখ লাগে যে, আমাদের দেশের এই বরেণ্য বিজ্ঞান সাধকের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি, কোন সংগঠন স্মরণ করার খবর পাওয়া যায়নি। এমন কি অনেকেই যশোহর জেলার এই বিজ্ঞান সাধকের নামও জানে না।

সরেজমিন যশোরের বকচার এলাকায় শত মানুষের কাছে খবর নিয়েও তাঁর সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি। দু’একজন প্রবীণ ব্যক্তি রাধার আকাশ দর্শনের কথা বলেছেন। কিন্তু বিস্তারিত জানাতে পারেননি। দেশ ভাগের পর একরকম রাধাগোবিন্দ চন্দ্র অভিমান করেই ভারতে চলে যায়। স্থানীয় প্রবীণদের কাছেই জানা যায়, তিনি তার বাড়িটি বিক্রি করেও যাননি।

নূর মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি শত্রু  সম্পত্তি হিসেবে ডিসি আর কেটে রাধা গোবিন্দের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। এরপর এই বাড়ির মালিক হন পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রোকন দারোগা। এখন এ বাড়ির লোকরাও রাধা গোবিন্দ চন্দ্রকে চেনেন না।

কিন্তু ভারতের কলকাতা, দিল্লি ও বারাসাতে রাধাগোবিন্দ চন্দ্র স্মৃতি রক্ষা সমিতি, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটি, বিড়লা ইন্ডসট্রিয়াল এন্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম প্রতিবছর রাধার জন্মবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠান করে।

রাধাগোবিন্দের ১১১ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় ১৫ দিনব্যাপী বক্তব্যমালা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এ ছাড়া রাধাগোবিন্দের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমেরিকার অ্যাভসেনা প্রদত্ত সেই দূরবীনটি দক্ষিণ ভারতের কাভালুর মানমন্দিরে ঐতিহাসিক মর্যাদায় ‘বাপুচন্দ্র’ নামে সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১০ আগস্ট দূরবীনটি এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতের ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে সমর্পিত করা হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞনী রণতোষ চক্রবর্তী ছাড়াও অনেকে রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের ওপর গবেষণা করেছেন।

বাংলাদেশ এই বাঙালিকে স্মরণ না করলেও ভারত, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স তাঁকে স্মরণ করে। জন্মবার্ষিকীতে বক্তৃতামালা প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে উঠে আসে রাধা গোবিন্দের আকাশদর্শনের ওপর লেখা নানা প্রবন্ধ। খ্যাতিমান এই মানুষটির কোন স্মৃতি যশোরের বকচরে নেই। তিনি অভিমান করে বাংলাদেশ ছেড়েছেন। তাঁর অভিমান ভাঙ্গাতে এ দেশের কেউই কখনো সোচ্চার হয়নি। ইউরোপ, আমেরিকার জ্যোতিবিজ্ঞান সংস্থাগুলো যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাঁকে কোনরূপ স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি তাঁর স্বজাতি।

অথচ, ইচ্ছে করলেই আমরা কিন্তু তাঁকে স্মরণ করতে পারি। ঢাকার আগারগাও-এ জাতীয় বিজ্ঞান যাদুঘর-এ রয়েছে দেশের একমাত্র মানমন্দির। ইচ্ছা করলে সেই মানমন্দিরের নাম রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের নামে করা যায়। যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি রাধাগোবিন্দের নামে রাখা যেত। এভাবে বাঙালির গর্বকে সম্মান জানানোর পথ খোলা রয়েছে। কিন্তু জানি এটি মোটেই হবার নয়। আমরা গুণীর কদর করতে জানি না।


মৃত্যু ও উত্তরাধিকার:
১৯৪৭ সালে, দেশ ভাগের পর রাধাগোবিন্দ কলকাতা চলে যান। ৯৭ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ৩ এপ্রিল বারাসতের দুর্গাপল্লীতে আর্থিক অনটনে একরকম বিনা চিকিৎসায় বারাসাতে তিনি মারা যান। এর আগে ৬ ইঞ্চি ব্যাসের ঐ দূরবীণটির একটি ভাল ব্যবস্থা তিনি করে যান। শেষ বয়েসে হার্ভার্ডে চিঠি লিখে জানালেন তাঁর পক্ষে আর বেশী পরিশ্রম করা সম্ভব নয়, কোন তরুন বিজ্ঞানী দূরবীণটি কাজে লাগাক। পরে এটি দেয়া হয় হায়দ্রাবাদের কে, ভেইনু বাপ্পুকে।


রাধাগোবিন্দকে নিয়ে প্রচার ও গবেষণা:
স্মৃতির ধুলোয় আবৃত জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ এখন অনেকটা ধুলোর আবরন হতে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। এখন এদেশে রাধাগোবিন্দকে নিয়ে চলছে গবেষণা, বই প্রকাশ, পত্র পত্রিকায় লেখালেখি, আলোচনা ইত্যাদি। আগে যেখানে তার জন্মস্থান বকচরের মানুষ কিম্বা তার পাশের বাড়ীর মানুষ জানতো না রাধাগোবিন্দ কে, বর্তমানে বাংলাদেশের অনেকেই রাধাগোবিন্দ সম্পর্কে জানেন। এ দেশের মানুষের কাছে রাধাকে পরিচিত করতে ভূমিকা রেখেছেন মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক, দার্শনিক বেনাজিন খান তার ‘প্রকাশিত গদ্য’ নামক বইতে রাধাগোবিন্দ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন লেখেন। লেখক মনোরঞ্জন বিশ্বাস তার ‘যশোর ইতিবৃত্ত’ নামে বইতে রাধাগোবিন্দ সম্পর্কে আর একটি প্রতিবেদন লেখেন।

By: jassore.info
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন