পবিত্র বেদে গো হত্যা ও ভক্ষণ নিষিদ্ধ। জানুন কেন ?

পবিত্র বেদে গো হত্যা ও ভক্ষণ নিষিদ্ধ। জানুন কেন ?

বেদের অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে হলে প্রয়োজন যথোচিত তপস্যা, ব্রহ্মচর্য ও উচ্চকোটীর গুরুর অধীনে নিষ্ঠা সহকারে স্বাধ্যায়, তদোপরি প্রয়োজন ভারতীয় মানসিকতা।
অধিকন্তু, সাহায্য নিতে হয় পাণিনির ব্যাকরন, যাস্কাচার্যের নিরুক্ত, দূর্গাচার্যের ভাষ্য তথা নিঘন্টু (বৈদিক মূল শব্দকোষ) এবং ব্রাহ্মন গ্রন্থসমূহ। উন্নাসিক পাশ্চাত্য মিশনারিসদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে কতিপয় পন্ডিৎবর্গ যেমন MacDonel, Keith, Maxmuller প্রমুখেরা সুমহান ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি তথা সভ্যতাকে হেয় করতে সায়ন মহীধর, উবট প্রমুখের বিকৃত বেদ-ব্যাখ্যাকেই হাতিয়ার করেছেন। অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করীরাও নিরলস গলা ফাটিয়ে শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রাচীন ভারতে অশ্বমেধ ও গোমেধ যজ্ঞ করা হতো। পল্লবগ্রাহীতা সম্পন্ন পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা মনে করেন যে উক্ত যজ্ঞে ঘোরা ও গরুকে আহুতি প্রদান করা হতো;
শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতে পিতৃযজ্ঞ ও অতিথিযজ্ঞেরও উল্লেখ আছে... সেখানে নিশ্চয়ই পিতা ও অতিথিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হতোনা। এর আসল অর্থ বুঝতে হবে নিঘন্টু থেকে।
সেখানে যজ্ঞের একটি প্রতিশব্দ হলো "অধ্বর" (৩/১৭)। যাস্কাচার্য নিরুক্তি করেছেন, 
"অধ্বর ইতি যজ্ঞানাম্।
ধ্বরতি হিংসাকর্মা, তৎপ্রতিষেধঃ"।
(১/৮)। 

'অধ্বর' শব্দটির দুটি ভাগ--- অ+ধ্বর। 'অ'-এর অর্থ নিষেধ এবং 'ধ্বর'-এর অর্থ হিংসা করা। সুতরাং, 'অধ্বর' কথাটির অর্থ হলো 'হিংসা না করা'। তাই বলা যায়, যজ্ঞকালে বৈদিক ঋষিরা কোনো
প্রকার প্রানী হত্যা বা আহুতি দিতেন না। বেদেই রয়েছে তার স্পস্টতর ঈঙ্গিত। যেমন: "অশ্বং মা (=না) হিংসীঃ" (যজুর্বেদ: ১৩/৪২)।
এটা ঠিক যে, ঋকবেদ (১০/৮৭/১৬), যজুর্বেদ (৮/৮৩) ও অথর্ববেদের (৯/৪/১৭) বিভিন্ন মন্ত্রে গরুর নাম 'অঘ্ন্য' বা 'অঘ্ন্যা' বলা হয়েছে। কিন্তু ঐ অঘ্ন্যা শব্দের প্রকৃত অর্থ কি?
যাস্ক মুনি এর অর্থ করেছেন--- 'অঘ্ন্যা অহন্তব্যা।'(নিরুক্ত ১১/৪৪)।
সুতরাং, 'গো' শব্দের সঙ্গে 'অঘ্ন্যা' যুক্ত থাকায় 'গোহত্যার' কথা ভাবা একেবারেই অবান্তর। মহাভারতের শান্তিপর্বেও ব্যাসদেব স্পস্টতঃই বর্ননা করেছেন---"অঘ্ন্যাং ইতি গবাং নাম ক এতান্ হন্তুমর্হতি?"। পানিণি-র টীকাতেও "গোঘ্নঃ" শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে "অতিথি পূজা" (গোঘ্নঽতিথিঃ)-র নিমিত্তে। তাই বেদে বর্নিত "গোঘ্নঃ" কখনোই বধ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।

"সূর্যায়া বহতু প্রাগাৎ সবিতা যমবাসৃজৎ।
অঘাসু হন্যতে গাব অর্জুন্যোঃ পর্য্যুহ্যতে।।"
(ঋক্ ১০/৮৫/১৩)

'হন্যতে গাব' কথাটিরও অপব্যাখ্যা করা হয়। এখানে 'হন্যতে' অর্থে 'হত্যা' নয়,প্রকৃত অর্থ 'তাড়না করা'। সায়নাচার্য-ও এখানে ভূল অর্থ করেননি। 'বিবাহোপলক্ষে কন্যার পিতা জামাতাকে যে গরু-বাছুর যৌতুক দিতেন, সূর্যের কম প্রখর কালে তাদেরকে বরের গৃহে তাড়না করেই নিয়ে যাওয়া হতো।' কখনো আবার গৃহীরা অতিথিকে দক্ষিনা হিসেবে গরু দান করতেন।
অন্যদিকে, বৈদিক শব্দকোষ নিঘন্টুতে 'গো' শব্দের প্রতিশব্দ হলো অঘ্ন্যা, অদিতি, অহী, মহী, জগতী ইত্যাদি। অ+দিত=অখন্ডনীয়া। যজুর্বেদে দেখা যায় তার স্পষ্ট ঘোষনা---

১) "গাং মা হিংসীরাদিতিং বিরাজম্" (১৩/৪৩)। 


অর্থ্যাৎ গরু অদিতি, সে বধের অযোগ্যা, তাকে হিংসা করো না।

২) "ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসীঃ পর মে ব্যোমন্" (১৩/৪৬)।


অর্থ্যাৎ মানুষকে যে ঘৃতদান করে, তার নাম অদিতি, তাকে হিংসা করো না।
পাশ্চাত্য চশমা দিয়ে বেদ ব্যাখ্যা না পড়ে, কেউ যদি স্বচক্ষে নিরপেক্ষভাবে শুধুমাত্র দেশীয়ভাষাজ্ঞানেও বেদ পাঠ করেন,তবে ঋক্-বেদের এই মন্ত্রটি এড়িয়ে
যাওয়ার কথা নয়।

মাতা রুদ্রানাং দুহিতা বসুনাং স্বমাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ।

প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়, মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ঠ।।

(ঋক্ ৮/১০১/১৫)


অর্থ্যাৎ, গরু হলো বসু, রুদ্র-আদিত্যদের কন্যা। মা ও ভগিনীর সমান। গরু দুধরূপ অমৃত দান করে। সবাই জেনে রাখো, "গরু"...যার নাম অদিতি, তাকে বধ করো না।
(মা বধিষ্ঠ)।

ইড়ে রন্তে হব্যে কাম্যে চন্দ্রে জ্যোতেঽদিতে সরস্বতী মনি বিশ্রুতি।
এতা তে অঘ্ন্যে নামানি দেবেভ্যো মা সুকৃতং ব্রূতাৎ।। 
(যজু ৮/৪৩)


এ মন্ত্রে প্রতিটি শব্দের সুগভীর অর্থ বৈদিক ঋষিদের উন্নত মানসিকতার এক অনন্য নজির। 

ইড়া= অন্নদাত্রী,উৎসাহদাত্রী।
রন্তা=আনন্দদায়িনী।
হব্যা=আদরনীয়া,পূজনীয়া।
কাম্যা=রমনীয়া। চন্দ্রা=সুদর্শনা।
জ্যোতি=দীপ্তিময়ী,পুষ্টিদায়িনী। 
অদিতি=অখন্ডনীয়া।
সরস্বতী=সুরদায়িনী।
 অঘ্ন্যা=অবধ্যা।

বেদে গো দেবতার এভাবেই স্তুতি করা হয়েছে। যেখানে গোমাতা দেবতা জ্ঞানে পূজিতা, সেখানে গো-হত্যা এক কল্পনাতীত বিষয়।
অপরদিকে, গরুকে যারা হিংসা করবে, তাদের প্রতি রয়েছে বেদের সুকঠিন বজ্রশাসন...
১) অন্তকায় গোঘাতম্।। (যজু ৩০/১৮) 
[গোঘাতকের প্রান দন্ডই বিধান।]

২) আরে তে গোধনমুত পুরুষঘ্নম্।। (ঋক্ ১/১১৪/১০) 
[গোহত্যাকারী ও নরহত্যাকারী দূর হও।]

এ বিষয়ে সংস্কৃতভাষা না-জানা তথাকথিত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতদের একখানি অবশ্য পঠিতব্য পুস্তক হলো ভারত বিখ্যাত পন্ডিৎ ঐতিহাসিক ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা "Hindu Civilisation"।
এই বইতে তিনি বেদের অর্থ যথাযথভাবে বুঝেই লিখেছেন--- The cow was already deemed aghnya,not to be killed (p.77)।
এতো সকল বৈদান্তিক প্রমান ও সিদ্ধান্ত স্বদর্পে ঘোষনা করে যে পূর্বকালে বৈদিক ঋষিগন কখনোই গো-ঘাতক ও গো-খাদক ছিলেন না। তবুও শোনা যাবে উল্টোসুর,
শাস্ত্রের পল্লবগ্রাহী অপব্যাখ্যা, শৃগালমতি ধূর্ত ভন্ডামি তথা বিপ্রলিপ্সা। পাশ্চাত্য পন্ডিৎদের দেশীয় উচ্ছিষ্ট ভোজীরা তবুও করে যাবে যৎপরোনাস্তি ভারতীয়ত্বের তীব্র অবমাননা। তথাপি বজ্রদীপ্ত কন্ঠে বলবো, আমাদের পুন্যশ্লোক পিতৃপুরুষগন তথা পবিত্রাত্মা আর্য ঋষিগন কদাপি ঐ সকল অভক্ষ্য ভক্ষন করতেন না, এটিই প্রকৃত বৈদিক সিদ্ধান্ত।
সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক!
শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্তী
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ

সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ প্রচারিত
নবীনতর পূর্বতন