নারীদের ঋতুবতীতা ও আমাদের কুসংস্কার। জানুন শাস্ত্র কী বলছে

নারীদের ঋতুবতীতা ও আমাদের কুসংস্কার। জানুন শাস্ত্র কী বলছে।

নারীদের মাসিক বা (ঋতুস্রাবকালীনে পিরিয়ডের) বিষয় নিয়ে পূজা, উপসনা, ও মন্দিরে উঠতে পারবে না এটা সনাতন হিন্দুধর্মে ধর্মীয় শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা নয় এটা একটি সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। এই সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্তারিত তথ্য নিচে দিয়েছি ভালো করে পড়ুন সত্যটা জানুন

ঋতু এর বাংলা অর্থ


১). প্রাকৃতিক অবস্হা অনুযায়ী বছরের বিভাগ, যথা গ্রীষ্ম বর্ষা শীত ইত্যাদি।
২). মেয়েদের মাসিক রজস্রাব, স্ত্রীরজ। [সং. √ ঋ + তু]।
(কাল)— মাসের যে কয়দিন মেয়েদের ঋতুস্রাব চলে।
৩). পতি, (রাজ)— ঋতুশ্রেষ্ঠ বসন্ত।
৪). (পরিবর্তন)— এক ঋতুর পরে আর এক ঋতুর আগমন, ঋতু বদলে যাওয়া। মতী বিণ. রজস্বলা, যার ঋতুস্রাব হয় এমন।৫). (স্নান)— ঋতুমতী হওয়ার পর চতুর্থ দিন স্নান করার সংস্কার।
মাসিক মানে ঋতুস্রাব ওপর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা একটি সামাজিক নিষেধাজ্ঞা যা নারীদের রজঃস্রাব জনিত বিষয়। ভারতে রজস্রাবকে নারীদেরকে কলঙ্ক ও সামাজিক বাধা হিসেবে গণ্য করা হয় কিন্তু এটা সম্পুর্ণ কুসংস্কার। এবং অধিকাংশ সমাজ ও ধর্মে, সাধারণত একটি ঋতুমতী নারীকে অশুচি বলে মানা হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতের আশ্চর্য্য ধর্মীয় ঐতিহ্য বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বিভিন্ন মত এই ঋতুস্রাবকে ঘিরে এখনও এটি সনাতন হিন্দু সমাজের অন্যতম কুসংস্কার। এখানে, আমি সনাতন হিন্দু সমাজের নারীর ঋতুস্রাবকে নিষেধাজ্ঞা সম্বন্ধে উল্লেখ করছি—
আসুন দেখি কিভাবে এই  মিথ্যা_নিষেধাজ্ঞা সনাতন ধর্মে পালন করা হয়।

হিন্দুধর্মে মিথ্যা আইন

হিন্দুধর্মের মতে, একটি ঋতুমতী নারীকে অপবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং কিছু নিয়ম দেওয়া হয় অনুসরণ করার জন্য। একজন হিন্দু ঋতুমতী নারীকে রান্নাঘর, পুজোর ঘর এবং মন্দিরে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয় না। তার জোরে জোরে কথা বলা, ফুল দিয়ে সেজে ওঠা ও কোনো ব্যক্তিকে স্পর্শ করা নিষেধ। হ্যাঁ, এই ধর্মীয় আচার এখনো অনুসরণ করা হয়! একটি ঋতুমতী নারী সমাজে নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়, এমনকি তার মাসিক শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে পরিবারে ফিরে আসতে অনুমতি দেওয়া হয় না।

কাশ্মীরের বিশেষ আইন

কাশ্মীরের নিজস্ব কিছু নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্বাস আছে এই রজঃস্রাব নিয়ে। রাজ্যের আইন অনুযায়ী, একটি ঋতুমতী নারী অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। বরং তাকে তার পরিবার ওই সময়ে যত্নে রাখে। কাশ্মীরিদের মতে, একজন ঋতুমতী নারীর সেবা করলে তারা ভগবানের আশীর্বাদ পেতে পারেন।
আমাদের হিন্দু শাস্ত্রে পৃথিবীকে মাতৃস্থানীয় বলা হয়। বেদে এই রকমই বলা হয়েছে তিনি আমাদের মাতা। পৌরাণিক যুগেও পৃথিবীকে ধরিত্রী মাতা বলা হত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী মহাজাগতিক ধারায় পৃথিবী যখন সূর্যের মিথুন রাশিস্থ আদ্রা নক্ষত্রে অবস্থান করে সেদিন থেকে বর্ষাকাল শুরু ধরা হয়। তাই আমরা জানি মেয়েদের ঋতুকাল বা রজঃস্বলা হয় এবং একজন নারী তারপরই সন্তান ধারণে সক্ষম হন।
সনাতন হিন্দু নারীরা কুসংস্কার বাদ দিয়ে সত্য জানার চেষ্টা করুন


আমাদের সনাতন ধর্মের নারীদের ঋতুস্রাবকালীন অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে এই বিষয় নিয়ে সনাতনধর্মের শুদ্ধতা ও পবিত্রতার এই বিষয়টি দেখা যাকঃ—

शुद्धाः पुता योषितो यज्ञिया इमा आपश्चरुमब सर्पन्तु शुभ्राः ।
अदुः प्रजां बहुलान्पशुन्नः पक्तौदनस्य सुकृतामेतु लोकम् ।।
अथर्ववेद
कन्द–११॑सुक्त–१॑१७


শুদ্ধাঃ পুতা যোষিতো যজ্ঞিযা ইমা আপশ্চরুমব সর্পন্তু শুভ্রাঃ ।
 অদুঃ প্রজাং বহুলান্পশুন্নঃ পক্তৌদনস্য সুকৃতামেতু লোকম্ ।। (অথর্ববেদ ১১/১/১৭)

অনুবাদঃ— এই বিশুদ্ধ, পবিত্র, অতিথিবান যুবতী নারীরা এবং তাদের পবিত্র কাজগুলি যেন পবিত্র নৌযানের মত পবিত্র জাহাজের দিকে চলে যায় এবং পবিত্রতার জন্য পবিত্র খাদ্যের জন্য যজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা আমাদের উন্নতচরিত্র বংশধর এবং প্রচুর সম্পদ দিতে পারে, এবং যারা ডিভাইনের জন্য খাদ্য প্রস্তুত এবং নিখুঁত করতে পারে তারা জীবনের সর্বোচ্চ অর্জনের ক্ষেত্রগুলিতে পৌঁছাতে পারে।

হিন্দুদের সনাতন ধর্মে সর্বোৎকৃষ্ট মানবতাবাদী ধর্ম বলা হয়েছে। আর হিন্দুদের সনাতন ধর্মশাস্ত্র কে বিশেষ করে বেদে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা দান করা হয়েছে। এবং বেদে নারীদের সর্বদা পবিত্র ও শুদ্ধতা প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে।
নারীদের পূজা করেই সর্বত্র জাত বড় হয়েছে, যে দেশে, যে জাতে নারীদের পূজা নেই, সে দেশে সে জাত কখনো বড় হতে পারেনি, কস্মিন কালেও পারবে না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে। তার প্রধান কারন- এইসব শক্তিমূর্তির অবমাননা করা।
(চিরজাগ্রত স্বামী বিবেকানন্দ)

যে জাতির নারী যত পবিত্র, সেই জাতি তত উন্নত। যে জাতির পুরুষ যত সংযত, সেই জাতি তত উন্নত। তোমরা প্রকৃত উন্নতি লাভ কর।
(শ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব)।

একমাত্র সনাতন হিন্দু সমাজেই নারীকে সর্ব্বোচ্চ মর্য্যাদা দান হয়ে ছিল, তাই হিন্দু সমাজেই নারীর আদর্শ ও কীর্ত্তি-গরিমা পরিপূর্ণরূপে অতুলনীয় গৌরবে বিকশিত হয়েছিল। হিন্দুসমাজে নারীর মর্য্যাদা শুধু দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় ; হিন্দু-সমাজে নারী দেবী, ভগবতী, বিশ্বজননী। হিন্দুর চোখে নারী শুধু স্নেহ-প্রীতি-শ্রদ্ধা-সন্মানের পাত্রী নয়; নারী দেবীরূপে পূজিতা।
(ঋষির অনুশাসন)

"যত্র নার্য্যস্ত পূজ্যস্তে রমস্তে তত্র দপবতা"
নারী যে সমাজে পূজা পান দেবতাগণ সেথায় বিরাজ করেন।
বৈদিক ধর্মে নারী অর্থাত্ 'মা' কে দেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধা করা হয়। (তৈত্তরীয় উপনিষদ : শিক্ষাবল্লী, ১১ অনুবাক)।

বৈদিক_উপনিষদের_যুগে_দেখতে_পাওয়া_যায়

মৈত্রেয়ী গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয়া নারীরা ব্রম্মবিচারে ঋষিস্থানীয়া হয়ে রয়েছেন। হাজার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সভায় গার্গী সগর্বে যাজ্ঞবল্ককে ব্রম্মবিচারে আহবান করেছিলেন।


পবিত্র বেদে সরাসরি ঋতুস্রাবকালীন বিধিবিধান নিয়ে বিস্তারিত নেই। কেননা বেদ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা জানতেন এটা স্বাভাবিক বিষয়। ঋতুস্রাবকালীন বিধিনিষেধ এবং নারীদের পবিত্র ও শুদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে মনুসংহিতা, ধর্মসূত্রে, (বেদাঙ্গ কল্পের অন্তর্গত বিধানসমগ্র) ও স্মৃতিতে।
ঋতুকালীন নারীদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়নি কোথাও। যেহেতু বারবার এই বিষয়টি বর্ণিত যে ঋতুস্রাবকালীন সময়ে নারী তপস্বিনীর ন্যায় আচরণ করবে, তাই মন্দিরে প্রবেশাধিকার আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে পূজা করার অনুমতি (অঙ্গিরস স্মৃতি ৩৭) ও অগ্নির কাছে না যাবার কথা আছে। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র ৫/৬)
নারীর তপস্বিনীর ন্যায় আচরণ ও ঋতুকালীন সময় যে তার শুদ্ধতার পবিত্র প্রতীক তা মনুসংহিতা ও বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বর্ণিত রয়েছে।।

মৃত্তৌয়ঃ শুধ্যতে শোধ্যং নদী বেগম শুধ্যতে।
 রজসা স্ত্রী মনোদুষ্টা সন্ন্যাসেন দ্বিজোত্তমঃ।।

(মনু ৫/১০৮)

অনুবাদঃ— মালিন বস্তু মৃত্তিকা ও জলাদি দ্বারা শুদ্ধ হয়, নদী শ্লেষ্মাদি-দূষিত হইলে শ্রোতে শুদ্ধ হয়। স্ত্রীলোক মনে মনে পরপুরুষামুকী হইলে ঋতু হইলেই শুদ্ধ হয় ব্রাহ্মণ পাপাচরণ করিলে ব্রহ্ম চিন্তন দ্বারা শুদ্ধ হয়।
(বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২৮/২-৩ তে বর্ণিত হয়েছে)।
অর্থাৎঃ— অগ্নিহোত্র যজ্ঞের অনুমতি নেই। নারীর তপস্বিনীর ন্যায় আচরণ ও ঋতুকালীন সময় যে তার শুদ্ধতার প্রতীক।
(মনুসংহিতা ও বশিষ্ট ধর্মসূত্রে বর্ণিত)

রজস্বলা নারীতে যে পুরুষ সঙ্গত হয় তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু ও চক্ষু ক্ষয় পায়।
(মনুসংহিতা, ৪/৪১)

ঋতুকালীন মলিন-বসন পরিত্যাগ করেছে সে নারীদের মধ্যে শ্রীযুক্তা বা লক্ষ্মীস্বরূপা।
(বৃহদারণ্যক, ৬/৪/৬)

নারী হলো মঙ্গলময়ী লক্ষ্মীস্বরূপ।
(অথর্ববেদ, ৭/১/৬৪)

মনের নিয়ন্ত্রণঃ— মন দি–রকমের। শুদ্ধ–অশুদ্ধ; পবিত্র–অপবিত্র। কামনা–বাসনা, ভোগ–লালসার যাবতীয় সঙ্কল্প বা ইচ্ছা হলো অশুদ্ধ মনের। আর শুদ্ধ বা পবিত্র মনের কোনো লৌকিক কামনা–বাসনা নেই।
(অমৃতবিন্দু উপনিষদ, ১)

আত্মা নারীও নন, পুরুষও নন এবং নপুংসকও নন। (কর্মের ফলে) আত্মা বিভিন্ন শরীর ধারণ করেন এব্য সেই সেই রূপেই তিনি পরিচিত হন।
(শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ, ৫/২০)

(ব্রহ্ম) তুমি নারী, তুমিই পুরুষ; তুমি বালক, বালিকাও তুমি; তুমিই বৃদ্ধ, তুমিই নানা রূপে জন্ম নাও।
(শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ, ৪/৩)

আত্মাতে নর–নারী ভেদ নেই। দেহে সম্বন্ধেই নর–নারী ভেদ। অতএব আত্মাতে নারী–পুরুষ ভেদ আরোপ করা ভ্রমমাত্র—শরীর সম্বন্ধেভ তা সত্য। অজ্ঞানই বন্ধনের কারণ।
এই_জ্ঞানলাভের_উপায়_কী?

ভগবানের মন্দিরজ্ঞানে সর্বভূতে প্রেমের দ্বারা সেই জ্ঞানলাভ হয়। তিনি সর্বভূতে অবস্থান করেন।
(চিরজাগ্রত স্বামী বিবেকানন্দ)

অন্যকে প্রেম ও সহানুভূতির চোখর দেখতে হবে। আমরা যে –পথ দিয়ে এসেছি তারাও সেই পথ দিয়ে চলছে। যদি তুমি বাস্তবিক পবিত্র হও, তবে তুমি অপবিত্রতা দেখবে কীভাবে? কারণ যা ভিতরে অপবিত্রতা না থাকলে বাইরে কখনোই অপবিত্রতা দেখতে পেতাম না।
(চিরজাগ্রত স্বামী বিবেকানন্দ)

হিন্দুর্ধের সারতত্ত্ব ষষ্ঠ অধ্যায়ে

(ব্রহ্মপ্রাপ্তির প্রস্তুতি ও পথেয়) তে নারীদেরকে নিয়ে বলা হয়েছে উপনিষদ্ কায়মনোবাক্যে মৈথুনত্যাগকে ব্রহ্মচর্য্য বলিয়াছেনঃ—
(শাণ্ডিল্য উপনিষদ্ (কঠ উপনিষদ্ বা কাঠকোপনিষদ্ ১)। ব্রহ্মচর্যং নাম সর্বাস্থাসু মনোবাক্কায়কর্মভিঃ সর্বত্র মৈথুনত্যাগঃ' ; যোগী যাজ্ঞবল্ক্য (১।৫৪) 
'কর্মণা মনসা বাচা সর্বাবস্থাসু সর্বদা সর্বত্র মৈথুনত্যাগো ব্রহ্মচর্যং....)।
এবং মৈথুনের সংজ্ঞা ব্যাপকতর করিয়া, প্রত্যক্ষ বীর্য্যক্ষয়কারী নহে অথচ কামোদ্দীপক, এরূপ বহু কার্য্য ব্রহ্মচারীর পক্ষে নিষিদ্ধ হইয়াছে। যথা নারী বিষয়ে চিন্তা, আলোচনা, নারীর সহিত সম্ভাষণ, ক্রীড়া, উপহাস (শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ১১।১৭।৩৩)।

['স্মরণং কীর্ত্তনং কেলিঃ....মুমুক্ষুভিঃ– স্ত্রীণং নিরীক্ষণ-স্পর্শ-সংলাপ-ক্ষেলনাদিকম্....ত্যজেৎ' ; (মনু সংহিতা ২।১৭৯)— '....স্ত্রীণাঞ্চ প্রেক্ষণালম্ভম্....]।
হিন্দুধর্মের প্রতিটি শাস্ত্রে নারী যেমন মাতাকে যতদূর সম্ভব মহীয়সী করিয়া প্রত্যেকটি জননীকে জগজ্জননীর প্রতিমূর্ত্তি বলিয়া করা হয়।
(শ্রীশ্রী চণ্ডী, ৫/৭২-৩)
যে নারী হিন্দুশাস্ত্রে উপদেশ দেয় তিনি 'রমণী'।
ঋষিগণ নারীদেহের আকর্ষণীয় বস্তুগুলির অসারত্ব বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়াছেন।
(নারদ-পরিব্রাজক উপনিষদ, ৪/২৯-৩০)

[স্ত্রীণামবাচ্যদেশস্য...কিমতঃপরম্']
যে উহাতে আকৃষ্ট হইবার কিছুই নাই।
[যাজ্ঞবল্ক্যােপনিষদ্ যজু (৮–১৬)]


'মাংসপাঞ্চালিকায়াস্তু দুঃখশৃঙ্খলয়া নিত্যমলমস্তু মম স্ত্রিয়া'], কিন্তু এরূপ চিত্তবিক্ষেপকারী মোহও আর কিছু নাই। সুতরাং সন্ন্যাসী বা যোগী, যিনি একমাত্র ভগবৎ চিন্তায় নিজেকে যুক্ত রাখিযা মুক্ত হইতে চান, তিনি যদি নারীমূর্ত্তির একটি কাষ্ঠপুত্তলিকা দেখিতে পান তবে তাহাকে পদ দ্বারাও স্পর্শ করিবেন না।
নারীর সহিত দৈহিক সম্বন্ধ শুধু রাখিবে পঞ্চযজ্ঞে। পৃ. ১১১]

সত্যজ্ঞানের জন্য বলা হয়েছে
সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।
(মুণ্ডকোপনিষদ, ৩/১/৬)

অনুবাদঃ— একমাত্র সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার নয়। কারণ, সেই দেবযান নামক পথ সত্যের দ্বারা লাভ করা যায়।

সনাতন ধর্মে একসময় নারীদের বেদ শাস্ত্রপাঠ ছিল। আসুন, বেদের শুভ্র, জ্ঞানের পথ অনুসরন করে বৈষম্যহীন সমাজ গঠন করি।
নারী অপবিত্র নয়, নারী পবিত্র হিন্দু পরমপুরুষ মনুর মতে সিদ্ধান্ত,
নারীরা কখনোই অপবিত্র নন। মাসের নির্দিষ্ট সময়ে সাময়িক অসুবিধা তাদের সমস্ত মনের পাপ ধুয়েমুছে সাফ করে পবিত্রতা আরো বৃদ্ধি করে।
(বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৮/৯)

ঋতুকালীন সময়ে মৈথুন নিষিদ্ধ

সমানশয়নে চৈব ন শ্যীত তয়া সহ।
রজসাভিপ্লু তেজো বলঃ চক্ষুরায়ুশ্চৈব প্রহীয়তে।।
(মনুসংহিতা, ৪/৪০)

অনুবাদঃ— কামে একান্ত উন্মত্ত হইলেও রাজোদর্শনে নিষিদ্ধ দিনত্রয়ে স্ত্রীগমন করিবে না, এবং তাহার সহিত সহবাস করিবে না।

নারীদের নিয়ে আমার কিছু কথা

অপবিত্রতা থেকেই সবারই জন্ম, যদি নারীদের থেকে হয় তাহলে নারী পুরুষ সবাই অপবিত্র। যে ধর্মস্থানে নারীর প্রবেশাধিকার নেই সেই স্থান কখনোই পবিত্র না। নারীদের পদস্পর্শ যে স্থানকে করে অপবিত্র তাহলে - সে আমার কাছে কোনো পবিত্র স্থান নয় আদৌ। দেহজ অপবিত্রতা আর অসতীত্ব শুধু নারীর বেলায় হয় তাহলে একই সংজ্ঞায় শৃংখলিত নয় পুরুষ, যদিও ধর্মের পাঠশালায় উজ্জ্বল তার বিপরীত শিক্ষা- প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চনারীর নাম। আজ শবরীমালা মন্দিরে নারীর পথ আগলে দাঁড়ায় যে পুরুষ সে কোন পবিত্র পুরুষ গর্ভজাত। হায় দ্রৌপদী! যুগে যুগে তোমার বস্ত্র হরনের আয়োজনে দুর্যোধনের অভাব হয়না বড্ড অপবিত্র আজ আমাদের বোধের জায়গাটি বড্ড জ্ঞানে হিসেব-নিকেশ বিবেক-বুদ্ধিতে বুঝা যায় তাই মানুষের মনে মনুষ্যত্ব বোধ নাই, ব্রাহ্মণের মাথায় শূন্যস্থানে ধর্মজ্ঞান নাই ধর্মস্থানে ধর্ম নাই। বেঁচে থাক শাস্ত্র-শাস্ত্রী বেদ-বিধি পদ শাস্ত্র কানা, আরেক কানা মন আমার-আমার কাছে সবচেয়ে পবিত্র এক নারী মা বোন আমার।

নারীদের ঋতুস্রাবকালীন

ওভালুয়েশন পিরিয়ড/মিন্সের বিষয়টা একেবারেই স্বাভাবিক এবং আমাদের সবার জন্মের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়/অত্যাবশ্যক একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা অধিকাংশ ছেলেরা সমাজ অপবিত্রতার কারণ মনে করে। এমনকি সমাজের এমন কপাল ঘোচানো-ভ্রু কুঁচকানো আচরণ দেখে নারীরাও একসময় এটাকে অপবিত্রতার লক্ষ্মণ মনে করতে শুরু করে। নতুন একটি প্রাণ পৃথিবীতে আনার পূর্ব প্রক্রিয়াস্বরূপ একটি নারী যখন প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিন গুলোতে ব্যাথায় কুকড়িঁয়ে যায়, দুমড়ে মুচড়ে যায় শরীরের ভেতরের নাড়ী নক্ষত্র পুরুষ বা সমাজ তার কিছুই টের পায় না। কখনো কোন নারীর পাজামায় ভুলবশত ও ঋতুস্রাবকালীন পিরিয়ডের রক্তের বিন্দুমাত্র দাগ দেখা যায়-সমাজ দাত কেলিয়ে হাসে আর লজ্জা দেয় নারীকে। অথচ ভাবে না আমাদের সবার মা বোনেই এই দুঃসহ যন্ত্রণা এবং সমাজের অপবিত্র দৃষ্টি উপেক্ষা করেই আমাদের কে এনেছিল পৃথিবীতে। আমাদের সবার মা বোনই মাসের একটা সময় এমন অস্বস্তিকর ভাবে দিন কাটায়। পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা ভ্রুঁ কুচকে আমরা তার ব্যাথা আর অস্বস্তিকে করে তুলি দ্বিগুন।

যুক্তিকথা

পূজা দেওয়া যাবেনা, এই ছোঁয়া যাবেনা, সেই করা যাবে না। আবার ডাবল স্টান্ডার্ড/সত্য এটাও যে- এই অপবিত্রতা না থাকলে কোন নারীকে জীবনসঙ্গিনী ও করা যাবেনা!
সকল অপবিত্রতা আর ঘেন্নার কারণ যেন আমাদের প্রত্যেকের জন্মের পূর্বশর্ত এই ঋতুস্রাবকালীন বা পিরিয়ডের! বাহ কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে সাতখুন মাফ
খুব কম ছেলেই পাওয়া যাবে যারা তাদের স্বপ্নদোষের জন্য অনুশোচনায় ভোগে কিংবা নিজের অন্যায়/খারাপ চিন্তাভাবনার ব্যাপারে কালক্ষেপণ করে। এটাকে তারা স্বাভাবিক একটা বিষয় বলেই এড়িয়ে যায় যদিও স্বপ্নদোষের মূল কারণ খারাপ/অনৈতিক চিন্তাভাবনা।
মোটকথাঃ— মেয়েদের ঋতুস্রাবকালীন/মিন্স অনৈতিক বা অপবিত্র নয় অপবিত্র-অনৈতিক ছেলেদের স্বপ্নদোষ।
সপ্নদোষকে কেন অনৈতিক বলছি
যৌনতা কোন অপরাধ বা অনৈতিকতা নয়। এর প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আকর্ষণ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক এবং তা প্রকৃতির ই নিয়ম। সেই সাথে একজন সৎ-নীতিবান-ধার্মিক ব্যক্তি চিন্তাভাবনায় সংযম ধারণ করে ব্রহ্মচর্য পালন করে উপযুক্ত পরিবেশ এবং সময়ে তার যৌন চাহিদা পূরন করবে সেটাও প্রকৃতিরই নিয়ম।

এর থেকে বিচ্যুতি অর্থ নৈতিকতার অবক্ষয় নয় কি?
অনেক ক্ষেত্রে আবার শারিরীক দুর্বলতা কিংবা অত্যাধিক মানসিক চাপেও স্বপ্নদোষ হতে পারে যা অনৈতিকতার আওতায় পড়েনা। মূলত সেক্স কে ট্যাবু করে রাখার কারণে এই বিশয়ে অজ্ঞতা থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন জল্পনা কল্পনা। আর তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের সংযম ধারণ করার ব্যাপার টা অধরাই থেকে যায়। তো নারীদের ঋতুস্রাবকালীন মত এমন স্বাভাবিক এবং অত্যাবশ্যকীয় একটা জৈবিক প্রক্রিয়া নারীদের পাশে না দাঁড়িয়ে উলটো অপবিত্রতার দোহাই দিয়ে পূজা কিংবা ভালো কাজে বাধা দেওয়াটা কি ধর্ম সংগত হতে পারে? নাকি এটা অজ্ঞতা বা কুসংস্কারেরই ফল? কারণ •••

সনাতন ধর্মে চিরন্তন বৈশিষ্ট্যাবলী। আর নারীদের ঋতুস্রাবকালীন নতুন প্রাণের আগমনী বার্তাবাহক এক সনাতন/চিরন্তন সত্য।

পূজায় অংশগ্রহণ করবে কি না তা সম্পূর্ণরূপে ঐ নারীদের উপরই সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত যিনি এমন কষ্টদায়ক পরিস্থিতি ভোগ করছেন। কষ্ট উপেক্ষা করে যদি তিনি মনকে ঈশ্বরের কাজে সমর্পণ করতে পারেন তবে আপনি আমি তাকে বাধা দেবার কে?
নারীদের অপমান করা মানে নিজের মা বোনকে অপমান করা। আর সনাতন হিন্দু সমাজে নারীর মর্য্যাদা অতুলনীয়।
তুচ্ছানাং যদ কুলশ্চ ,নারীনাং এব ভবেৎ।
বিনাশং স কুলধর্ম অধোগতিম প্রাপ্সসি এতৎ।।

অনুবাদঃ— এই জগতে যে কুল বা সমাজে নারীদের তুচ্ছজ্ঞান করে, সে কুল বা সমাজ ধর্মভ্রষ্ট হয়ে নরকগামী হয়।।
দেশ ও নারী দুটোকেই মাতৃরুপে দেখা উচিত।

শ্রী বাবলু মালাকার
(সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, চট্টগ্রাম)
নবীনতর পূর্বতন