গীতার দ্বারা অনুপ্রাণিত এক আবিষ্কারকের জীবনগাঁথা।

গীতার দ্বারা অনুপ্রাণিত এক আবিষ্কারকের জীবনগাঁথা।

শ্রীগীতার দ্বারা অনুপ্রানিত এক মহান আবিষ্কারকের জীবনগাঁথা। গীতার দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের পর তিনি তার প্রথম পরীক্ষার ভয়াবহতা দেখে গীতার বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই উক্তিটি তার মনে পড়ে " আমিই সেই লোক ক্ষয়কারী ভীষণ মহাকাল "।

তখন তিনি ডিনামাইট আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেলের মত মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং এডওয়ার্ড টেলরের হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কারের বিরোধিতা শুরু করেন। তাই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়।

ডিনামাইটের মত পারমানবিক বোমা মানবজাতির আতঙ্ক দিয়ে সৃষ্টি হলেও এ আনবিক শক্তি হয়ে উঠছে বিশ্বের চালিকাশক্তি।

সুব্রত শুভ  - 

১৯৬৩ সাল। অনুষ্ঠানে উপন্থিত আছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন। 

আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু রবার্ট ওপেনহেইমার। 

আজকে তাঁকে আণবিক শক্তি কমিশনের প্রদেয় এনরিকো ফার্মি পুরস্কার ভূষিত করা হবে। 

কিছুক্ষণ পর দুর্বল শরীর নিয়ে ওপেনহেইমান পুরষ্কার গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্টে এর হাত থেকে। 

১৯৬৬ সালে তিনি ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি থেকে অবসর নেন।

অবসর নেওয়ার এক বছর পর ১৯৬৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রিন্সিটনে মারা যান। 
ইহুদি ধর্মমত অনুসারে তাঁর দেহভষ্ম ছড়িয়ে দেওয়া হবে ভার্জিল আইল্যান্ডের সমুদ্রে।


১৯০৪ সালের ২২শে এপ্রিল নিউ ইয়র্ক সিটিতে এক ইহুদি পরিবারে ওপেনহেইমার জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম জে.রর্বাট ওপেনহেইমার। তাঁর পিতা জুলিয়াস ওপেনহেইমার ১৭ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে জার্মানী থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমান। পিতা টেক্সটাইল শিল্পে আমদানী-রফতানীর ব্যবসা করতেন এবং তাতে সফলতা পান। মা এলা ফ্রাইডম্যান প্যারিসে পড়াশুনা করেছেন, বিয়ের আগে তিনি ছিলেন আর্টের শিক্ষিকা । পারিবারিকভাবে ওপেনহেইমারের পিতা-মাতা সংগীত, আর্ট পছন্দ করতেন। ১৯১২ সালের ১৪ অগাস্ট ওপেনহেইমার দম্পতির কোল জুরে আরো একটি সন্তান আসে নাম তাঁর- ফ্রাঙ্ক ফ্রেইডম্যান ওপেনহেইমার। ভবিষ্যতে বড় ভাইয়ের মতন সেও একদিন পদার্থ বিজ্ঞানী হবে এবং পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হবে।
ছেলেবেলা থেকেই ওপেনহেইমার ছিলেন পড়াশুনার প্রতি আগ্রহী। নিউ ইর্য়কে নামকরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে স্কুল জীবনের সূচনা হয়। স্কুল থেকে দেওয়া হোমওয়ার্ক, কবিতা লেখা, বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল সবসময়। মাত্র ৫ বছর বয়সে ওপেনহেইমার দাদা’র সংগ্রহ করা কিছু খনিজধাতু উপহার হিসেবে পান। ধাতুগুলো এসেছিল জার্মান থেকে। ১১ বছর বয়সে ওপেনহেইমারের খনিজধাতুর একটি ভাল সংগ্রহশালা গড়ে উঠে। ফলে এসব সর্ম্পকে তাঁর জানাশোনা হয় প্রচুর। ১১ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নিউইয়র্কের ‘নিউইয়র্ক মিনারোলজিক ক্লাবে’ তিনি সদস্য হোন।

১৯২২ সালে ওপেনহেইমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমেস্ট্রিতে ভর্তি হোন। কিন্তু শিঘ্রই ফিজিক্সে চলে আসেন। হাভার্ডে পড়ার সময় রর্বাট বিখ্যাত অধ্যাপক পার্সি ডাব্লিউ ব্রিজম্যান দারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হোন। পড়াশুনায় কে আরও ভাল করে জানার নেশায় ল্যাটিন ও গ্রিকভাষা আয়ত্ব করেন। এছাড়াও ওয়েস্টান, চাইনিজ, হিন্দু ফিলসফিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ওপেনহেইমার পরীক্ষায় ৯৫% এর উপর নাম্বার নিয়ে চার বছরের কোর্স ৩ বছরেই শেষ করে ‘SOMMA CUM LAUDE’ সনদ পান।
এর পর পাড়ি জমান ফিজিক্স এর প্রাণভূমি ইউরোপে। ১৯২৫-২৬ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করেন। সেখানে দেখা মেলে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এর সাথে। রবার্ট যখন ইউরোপে গবেষণা করছে তখন জার্মানির হাইজেনবার্গ, বর্ন, স্কোডিনগার এ কোয়ান্টাম মেকানিজ নিয়ে গবেষণা চলছে। ম্যাক্স বর্নের সাথে কাজ করার আমত্রণ পাওয়া মাত্র রবার্ট তা লুফে নেয়। সেখানে তিনি নিলস বোর এবং পি.এ.এম. দিরাক প্রমূখ প্রথিতযশা পদার্থবিদদের সাহচর্য্য পান। এসময়ে কোয়ান্টামতত্ত্বের ওপর ওপেনহেইমারের দুটি মৌলিক প্রবন্ধ ‘জার্নাল অব দ্যা ক্যামব্রিজ ফিলোসোফিক্যাল সোসাইটিতে’ প্রকাশিত হয়। এসময় অনেকে তাঁকে ‘বিস্ময় বালক’ নামে ডাকা হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে ওপেনহেইমার মোট ১৬ টি পেপার বের করতে সমর্থন হোন এবং ১৯২৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
ডক্টরেট শেষে আমেরিকায় ফেরত আসার পর রর্বাট অসংখ্য চাকরির অফান পান। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্যার্লিফোনিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে যোগ দান করেন। এক বছর পর ১৯২৯ সালে কনিষ্ঠতম প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৩১ সালে রর্বাট-এর মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুতে তিনি প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েন। তার প্রিয় বন্ধু হাবার্ট স্মিথ সান্ত্বনা দিতে গেলে ওপেনহেইমার বলেন,এখন আমি হচ্ছি পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম ব্যক্তি।
বিচারের সময় জবানবন্দিতে রর্বাট ওপেনহেইমার বলেন-“তিনি কখনো টিভি, পত্রিকা এমনকি ম্যাগাজিনও পড়তেন না। তিনি তাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।” মায়ের মৃত্যুর পর রর্বাট ২২ বছর বয়সী ডাক্তারী পড়ুয়া জিন টাটলকের প্রেমে পড়েন। জিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। সেই সময় জিন নিজের জগতের সাথে রবার্টের পরিচয় করিয়ে দেন। বলা হয়, প্রেমের কারণে রবার্টও একজন কমিউনিজমের সমর্থক হয়ে উঠেন। ১৯৩৪ এ সানফ্রান্সিসকোতে শ্রমিকদের ধর্মঘট ও রাস্তায় হাঙামা সংগঠিত হয়। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে সেই বিদ্রোহে জিন টাটলের সমর্থন ছিল। সর্ম্পকের তিন বছর পর জিনের সাথে রর্বাটের সম্পর্কে ছেদ ঘটে। পরবর্তীতে রবার্ট ওপেনহেইমারের বিচারের ট্রায়ালে তাঁর সাবেক প্রেমিকার সর্ম্পকের ইতিহাসও উপস্থাপিত হয়।
১৯৩৭ সালে ওপেনহেইমারের পিতার মৃত্যু হলে তিনি সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হোন। সমস্ত সম্পত্তি তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উইল করে যান,যাতে এই অর্থ দিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা যায়। এরপর ১৯৪০ সালে ওপেনহেইমার ২৯ বছর বয়সী কিটি হেরিসনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। ওপেনহেইমার ছিলেন কিটির চতুর্থ স্বামী। কিটি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সাবেক সদস্য। বিবাহের সাত মাস পর তাঁদের প্রথম সন্তান পিটারের জন্ম হয়।

১৯৩৯ সালের ১ লা সেপ্টেম্বরে হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালের ৬ই এবং ৯ই আগস্ট জাপানের উপর আমেরিকার পারমানবিক বোমা আক্রমনের মধ্য দিয়ে। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশ (জার্মানী, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান) পারমানবিক বোমা তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠে। হিটলার পারমানবিক বোমা বানানো কাজ শুরু করে দিয়েছে এমন ধারনার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে পদার্থ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কে দিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখান। সে চিঠিতে তিনি ইউরেনিয়াম-২৩৫ সম্বৃদ্ধকরণ নাজি জার্মানীর অগ্রগতি সম্পর্কে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে দেওয়া হয় এবং তাকে পারমানবিক বোমা তৈরীর উদ্যোগ নিতে বলা হয়। যদিও এই বোমা মানুষের উপর কখনো ফেলা হবে এমনটা তিনি কখনো ভাবেন নি। পরবর্তীতে এই চিঠির জন্য আইনস্টাইন সারা জীবন অনুতাপ করে গেছেন। যাই হোক, আইনস্টাইনের স্বাক্ষরযুক্ত চিঠি ব্যাক্তিগত বন্ধু আলেক্সান্ডার স্যাকস এর হাত ঘুরে প্রেসিডেন্ট এর হাতে পৌছালো প্রায় দুই মাস পর ১১ ই অক্টোবর ১৯৩৯।
হিটলারকে উচিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল লেসলি গ্রোভসকে ‘পারমাণবিক বোমা’ বানানোর নির্দেশ দেন। এবং বিজ্ঞানীদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাথে সাথে বিষয়টি যেন গোপন থাকে সেই বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়। সেই সময়ে অন্যদের তুলনায় ওপেনহেইমার ছিলেন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। নিজের কর্মক্ষেত্রে তিনি সফলতার সাথে এগিয়ে চলছিলেন। ফলে রর্বাট ওপেনহেইমারকে প্রোজেক্ট প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। প্রোজেক্টের নাম দেওয়া হয়-‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। দায়িত্ব পেয়ে ওপেনহেইমার কাজে নেমে গেলেন। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা তাঁর পুরনো অভ্যাস। ওপেনহেইমার মেধাবী ও বড় বিজ্ঞানী হলেও তিনি নোবেল পুরষ্কারের মতন কোন বড় পুরষ্কার পান নি। কিন্তু তার প্রজোক্টে অনেক বিজ্ঞানী ছিলেন যারা অতীতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনিত হয়েছেন। ব্যক্তিগত ইগো কাজে বাঁধা সৃষ্টি করবে এমন ধারনা করা হলেও পরবর্তীতে ওপেনহেইমারের ব্যবহার ও কাজ করার দক্ষতায় গবেষণার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে যায়।

শুরু হয় ইউরেনিয়াম আকরিক সংগ্রহের কাজ। হেইমারের দিক নির্দেশনায় গোপন ল্যাবরেটরিতে বোমা বানানোর কর্ম-পদ্ধতি, পরিকল্পনা শুরু হয়। জেনারেল লেসলি গ্রোভস ছিলেন বিজ্ঞানী ও প্রোজেক্টকে গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্বে। বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে এই প্রোজেক্টের কোন সংবাদ রাশিয়া কিংবা বাহিরের কোন রাষ্ট্র বা সংগঠনের কাছে যেন না পৌছায় সেজন্য বিজ্ঞানীদের উপরও নজর রাখা হোত। জেনারেল লেসলি গ্রোভস কমিউনিস্টদের ঘৃণা করতেন। ওপেনহেইমারের অনেক বন্ধু যারা ছিলেন যারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তারপরও জেনারেল লেসলি গ্রোভস বিশ্বাস করতেন পারমানবিক বোমা বানানোর জন্য ওপেনহেইমার হলেন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি। ল্যাবরেটরির যারা বোমা বানানোর সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সবার উপর গোয়েন্দা নজরদারী করা হতো। সবচেয়ে বেশি নজরে রাখা হতো ওপেনহেইমারকে। তার গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে সবার উপর এফবিআই নজরদারি করতো। ম্যানহাটন প্রজেক্ট’এর সময় ওপেনহেইমার তার প্রেমিকার সাথে দেখা করেন। দেখার করার ছয় মাস পর জিন টাটলক একটি নোট লিখে নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেন।
মানহাট্টান প্রজেক্টে কর্মরত উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীরা ছিলেন- রবার্ট ওপেনহাইমার ( Robert Oppenheimer) ডেভিড বম(David Bohm) লিও শিলার্ড (Leo Szilard) ইউজিন উয়িগনার (Eugene Wigner), অটো ফ্রিশ (Otto Frisch),রুডলফ পিয়ারলস ( Rudolf Peierls), ফেলিক্স ব্লক (Felix Bloch) নেইল বোর( Niels Bohr) এমিলিও সেগর (Emilio Segre), জেমস ফ্রাঙ্ক ( James Franck) এনিরকো ফারমি,( Enrico Fermi), ক্লাউস ফুক্স ( Klaus Fuchs ) এবং এডোয়ার্ড টেলার ( Edward Teller)। এদের সবার গতি বিধির উপর সার্বক্ষনিক নজর রাখা হতো। কার সাথে কী কথা বলছে টেলিফোনের সেই কথাগুলো আড়িপেতে রেকর্ড করা হতো। বিশেষ করে ওপেনহেইমারের টেলিফোনে সকল রেকর্ড এফবিআই তার জন্য বানানো ফাইলে টুকে রাখতো।
১৯৪৫ সালে মার্চ মাসে জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে বিজ্ঞানীদের উদ্যমে ভাটা পড়ে। তাদের অনেকে এই প্রোজেক্ট বন্ধ করার পক্ষে মতামত দেন। এবং এই বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লেখেন তারা। কিন্তু চিঠি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের হাতে পড়ার কয়েক ঘন্টা আগেই মারা যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন ট্রুম্যান। ট্রুম্যান বিজ্ঞানীদের অনুরোধে সাড়া না দিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন। ১৯৪৫ সালের ১২ জুলাই, রাত ৪.৩০ মিনিট, লস অ্যালামস ল্যাবরেটরির কন্ট্রোল রুমে বিজ্ঞানীরা ভাবী উত্তেজনায় উন্মুখ। সব রঙের বাটনটির ওপর ওপেনহেইমারের তর্জনী। কাউন্ট ডাউন শুরু হলো, টেন-নাইন… ওয়ান-জিরো। হাজার হাজার সূর্য যেন একসাথে জ্বলে উঠলো। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে তীব্র কমলা লাল আলোয় ছেয়ে গেল গোটা আকাশ। কিছুক্ষণ পরেই ভয়ঙ্কর শব্দে শকওয়েবের তীব্র ধাক্কায় নড়ে উঠলো মাটি, দুলে উঠলো ল্যাবরেটরি, তারপর নিঃসীম নীরবতা, নির্বাক বিজ্ঞানীরা, কয়েক মুহূর্তের পর চমক ভাঙলো বিজ্ঞানীদের। উল্লাসে ফেটে পড়লেন তারা। ওপেনহেইমারকে তরুণ কয়েকজন বিজ্ঞানী কাঁধে তুলে নাচতে লাগলেন। হ্যান্ডশেক আর কোলাকুলি করতে করতে ওপেনহেইমারকে তারা ব্যস্ত করে তুললেন। পারমাণবিক বোমার জনক তখন একইসাথে আনন্দিত এবং ভবিষ্যৎ ভাবনায় ব্যথিত।

এ প্রসঙ্গে পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি জবাব দেন, দুর্নিবার আবিষ্কারের নেশা যখন বিশ্বকে পেয়ে বসে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করার সময় তখন থাকে না। একজন বিজ্ঞানীর সাধ্য কী যে সে তা রুখে!

১৯৪৫ সালে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষাটি দেখার পর ভগবদ্গীতার  একাদশ অধ্যায় বিশ্বরূপ দর্শন যোগের ৩২ সংখ্যক শ্লোকটি থেকে "আমি লোকক্ষয়কারী অতি ভীষণ কাল; এক্ষণ এই লোকদিগকে সংহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি; কথাটি তার মনে পড়েছিল ওপেনহেইমার তাঁর আশা ও ভয়কে প্রকাশ করেছিলেন ভাগবদ গীতার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে –
In battle, in the forest, at the precipice in the mountains, 
On the dark great sea, in the midst of javelins and arrows, 
In sleep, in confusion, in the depths of shame, 
The good deeds a man has done before defend him ”
হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমার ধ্বংশযজ্ঞ দেখে আতকে উঠেছিল সারা পৃথিবী। আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল “ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে?” আইনস্টাইনের উত্তর ছিল “ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানি না , তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ যে লাঠি এবং পাথর দিয়ে হবে তা বলতে পারি”।” I know not with what weapons World War III will be fought, but World War IV will be fought with sticks and stones.” হিরোশিমা ও নাগাসারিকর অবস্থা দেখে ওপেনহেইমারও ব্যথিত হোন। মারণাস্ত্র তৈরিতে পিছিয়ে ছিল না আরেক পরাশক্তি অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদিকে এডওয়ার্ড টেলর হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য পায় প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছ থেকে। অপরদিকে হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কারের বিরোধিতা করেন ওপেনহেইমার। পারমানবিক বোমার পরিণতি দেখেই তিনি হাইড্রোজেন বোমার বিরোধীতা করেন। কিন্তু এই বিষয়টি ভাল চোখে নেয় নি প্রসিডেন্ট ট্রুম্যান। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় ওপেনহেইমারের বিরুদ্ধে। আমেরিকা রাষ্ট্র যখন ওপেনহেইমারকে নিরাপত্তার প্রশ্নে বিচারের সম্মুখিন করা হয় তখন আমেরিকার জনগণের মনে যে প্রশ্নটির উদয় হল; ওপেনহেইমার যদি বিশ্বাসী ব্যক্তি না হয় তাহলে বিশ্বাসী ব্যক্তিটি কে?

আমেরিকার সেই সময় কমিউনিস্ট আতংক বিরাজ করছিল। শুধু ওপেনহেইমার নয় চার্লি চ্যাপলিন কেও কমিউনিস্ট ভাবা হতো। অনেকেই সন্দেহ করতেন চার্লি চ্যাপলিন হয়তো কমিউনিস্ট। আর সে কারণেই হলিউডের ওয়াক অব ফেম থেকে তাঁর পদচিহ্ন নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা হারিয়ে যায়। ১৯৪০ সালে নাৎসি শাসনামলে ব্যঙ্গ করে তৈরি ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ হিটলারের ভূমিকায় চ্যাপলিনের অভিনয় বিশ্বজুড়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকার শীতলযুদ্ধ যুদ্ধ চলার সময় চার্লি চ্যাপলিনের বামপন্থী মনোভাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে করে আমেরিকা। ১৯২৩ সালে আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টিকে আর্থিক অনুদান দেয়ায় দেশটির সরকারের সন্দেহ আরো জোরদার হয়ে ওঠে। কিন্তু চ্যাপলিন নিজে কখনো তার বামপন্থী যোগাযোগ স্বীকার করেন নি। ১৯৫২ সালে ‘লাইমলাইট’ সিনেমার প্রিমিয়ার শো’তে লন্ডনে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার অভিযোগ এনে চ্যাপলিনকে আমেরিকায় প্রবেশের অনুমতি দেননি দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল জেমস ম্যাকগ্রেনারি। আর তখনই চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে এমআই-৫-কে তদন্তের অনুরোধ জানায় আমেরিকা। সেই তদন্তের রিপোর্টই বৃটেনের জাতীয় সংগ্রহশালা (ন্যাশনাল আর্কাইভস) সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। তবে এই বিতর্ককে গুরুত্ব দিতে রাজি নন সাবেক এমআই-৫ প্রধান জন ম্যারিয়ট। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চ্যাপলিন হয়তো বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু তার উপস্থিতি কোনো দেশের জন্যই বিপজ্জনক ছিল না।’ তবে বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, চার্লি চ্যাপলিনের নাগরিকত্ব নিয়ে ওঠা বিতর্ক সে সময় আমেরিকা সরকারের বাম-বিদ্বেষ আরো একবার প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। তবে চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন- “মানুষকে ভালোবাসার জন্য যদি আমাকে কমিউনিস্ট হতে হয় তাহলে আমি কমিউনিস্ট।’’

ওপেনহেইমারের ভাই পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ফ্রেইডম্যান ওপেনহেইমার ১৯৮৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কণা পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্পের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ফ্রাঙ্ক বিখ্যাত ম্যানহাটান প্রজেক্টে কাজ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন রবার্ট ওপেনহেইমার। ফ্রাঙ্ক এই প্রকল্পে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৩৭-৩৯ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাকে ঝামেলায় ফেলে। তিনি ম্যাকার্থিজমের স্বীকার হন। সে সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অব মিনোসোটায় পদার্থ বিজ্ঞানে শিক্ষকতা থেকে অব্যাহতি নেন। কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। সে সময় কলোরোডার একটি হাইস্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর সুযোগ পান। পরে ইউনিভার্সিটি অব কলোরোডাতে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর সুযোগ মেলে। ১৯৬৯ সালে সানফ্রান্সিকোতে একপ্লোরোটোরিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন।

১৩ বছর ধরে এফবিআই অনেক চেষ্টা করেও ওপেনহেইমার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন এমন কোন প্রমাণ দিতে পারে নি। তবে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাগিরি ও বিচাররের মুখোমুখির কারণে ওপেনহেইমার পারিবারিক জীবনে ধস নামে। স্ত্রী সবকিছু ভুলে থাকার জন্য মদের নেশায় ডুবে থাকতেন। সামাজিক অসম্মান সহ্য করতে না পেরে কন্যা ক্যাথরিন আত্মহত্যা করেন। পুত্রের ভবিষ্যত হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। বিচার চলাকালীন হেইমানকে তার বিভিন্ন পদ থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয় কিন্তু একদল বিজ্ঞানীর প্রতিবাদের মুখে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পরে শুরু হয় আমেরিকার “কমিউনিজম” জুজু ও আতংক। আর সেই আতংকের বলি হোন অনেকেই। জে.রবার্ট ওপেনহেইমার তাদের মধ্যে অন্যতম।
কৃতজ্ঞতায়-
১. J Robert Oppenheimer biographical memoir by H.A.bethe
২.American Experience the Trials of J Robert Oppenheimer PBS Documentary
৩. রবার্ট ওপেনহেইমার -বিস্ময়কর এক প্রতিভার অপমৃত্যু!- সেভেরাস স্নেইপ 
৪. উইকিপিডিয়া
৫. মানহাট্টান প্রজেক্ট এবং পারমানবিক বোমার জন্ম। (Manhattan Project and the birth of the Atom Bomb)
৬. আমেরিকার সন্দেহ থেকে নাগরিকত্ব বিতর্কে চার্লি চ্যাপলিন-যায়যাদিন 
৭. মহামানবিক ভুল অথবা দুঃস্বপ্নের গল্প- সাক্ষী সত্যানন্দ 
(গত বছর ওপেনহেইমারের উপর মুভি ও কিছু ডকুমেন্টরি দেখার পর ওপেনহেইমার সম্পর্কে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। লিখতে গিয়ে দেখি; অনেকেই তার জীবন নিয়ে ব্লগ লিখে ফেলেছেন। রর্বাট ওপেনহেইমারকে নিয়ে সামু ব্লগের সেভেরাস স্নেইপ কয়েক বছর আগেই “রবার্ট ওপেনহেইমার -বিস্ময়কর এক প্রতিভার অপমৃত্যু!” নামে দুই পর্বের চমৎকার ব্লগ লিখেছেন। ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে ওপেনহেইমারকে নিয়ে লেখা এটি লেখা। তবে এই লেখায় স্নেইপের লেখার ছায়া ও তথ্য আছে।)
নবীনতর পূর্বতন