সূর্যোদয়েই নতুন দিনের সূচনা হয় - শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

সূর্যোদয়েই নতুন দিনের সূচনা হয়, Kushal Baran Charakraborty


এই ভূখণ্ডে সুপ্রাচীনকাল থেকেই সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই একটি নতুন দিনের শুরু হয়। আমাদের দিনরাত্রির ঐতিহ্য সম্পূর্ণ নৈসর্গিক এবং প্রাকৃতিক।সূর্যদয়ের পূর্বে এবং পরবর্তী সময়কে ঊষাকাল এবং প্রত্যুষকাল বলে। প্রত্যুষ থেকে সূর্য যখন মধ্যগগনে থাকে তখন তাকে মধ্যাহ্ন বলে। মধ্যাহ্ন থেকে যখন সূর্যাস্ত হয় তখন থেকেই রাত্রি শুরু হয়ে, সে রাত্রি শেষ হয় সূর্যোদয়ে। সূর্যাস্তের আগের ২৪ মিনিট এবং পরের ২৪ মিনিট এই ৪৮ মিনিট সময়কে সন্ধ্যাকাল বলে। এবং সূর্যাস্তের আগের ২৪ মিনিট সময়কে গোধূলি বলে। একটি দিনের ২৪ ঘন্টা অষ্টপ্রহরে বিভক্ত। এরমধ্যে তিনটি সন্ধ্যাকাল। প্রাচীনকালে প্রহর, দণ্ড, মুহুর্ত, পল, নিমেষ ইত্যাদির মাধ্যমে সময় গণনা হত।

১ প্রহর = ৩ ঘণ্টা
১ মুহূর্ত = ৪৮ মিনিট 
১ দণ্ড = ২৪ মিনিট
১ পল = ২৪ সেকেন্ড (প্রায়)
১ নিমিষ = ০.৪২৬৭ সেকেন্ড
১ দিবারাত্রি = ৩০ মুহূর্ত
১ লঘু = ১৫ ক্ষত
১ ক্ষত = ১০ নিমিষ
১ মুহূর্ত = ১৫ কাল
১ দিন = ৮ প্রহর/৬০ দণ্ড
১ কাল = ৩০ ক্ষত।

কোন রকমের নৈসর্গিক পরিবর্তন ছাড়া রাত্রি ১২ টা ১ মিনিটে দিন শুরু হওয়া ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের কাছে যৌক্তিক হতে পারে, কিন্তু আমাদের কাছে বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। পৃথিবীতে 'নিশীথ সূর্যের দেশ' বা রাত্রিকালীন সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে শুধু নরওয়ের নাম আমরা সবাই জানলেও; প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে আরো অনেক দেশ আছে যেখানে সূর্য সারারাত জেগে থাকে।

পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী অক্ষাংশ দূরে আঁকা একটি কাল্পনিক রেখাকে সুমেরুবৃত্ত বলে। এর থেকে উত্তরে অবস্থিত এবং কুমেরুবৃত্ত বা দক্ষিণ মেরু থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী অক্ষাংশে কল্পিত রেখা থেকে আরো দক্ষিণে অবস্থিত স্থানগুলোতে গ্রীষ্মকালে সূর্য অস্ত যায় না। এজন্য এ স্থানগুলোতে স্থানীয় সময় যখন মধ্যরাত হয়, তখনও আকাশে সূর্যকে দেখতে পাওয়া যায়। এ সকল এলাকা হল- উত্তর মেরুর আগে, সুমেরুবৃত্তের পরে কানাডার বেশ কিছু এলাকা, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, গ্রীনল্যান্ড, রাশিয়ার কিছু অংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা।

ফিনল্যান্ডের সব থেকে উত্তরে প্রায় দুই মাস সূর্য অস্ত যায় না।  এর বিপরীতে ইউরোপের সর্বউত্তরের লোকবসতি নরওয়ের ভালবার্দ দ্বীপপুঞ্জে মোটামুটি ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সূর্যের কোনরকম দর্শনই পাওয়া যায় না।

বৃহত্তর ভারতবর্ষ সহ বাংলাদেশে যেমন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নতুন দিনের শুরু হয় এবং মানুষের জীবনযাত্রা শুরু হয়। ঠিক তেমনি সময়মত সূর্যোদয় না হওয়াতে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক সহ স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে দিবারাত্রি হয় ঘড়ির কাঁটায়। মানুষের সকল কাজকর্ম চলে ঘড়িকে অনুসরণ করে। ঘড়িই সেখানে সূর্যের ভূমিকা পালন করে। আবহাওয়ার তারতম্যের জন্যে সূর্যকে অনুসরণ করে দিবারাত্রি বোঝার উপায় থাকে না। 

কিন্তু ভারতবর্ষ সহ বাংলাদেশে সে বিপদ নেই। এখানে সূর্যোদয় অথবা সূর্যাস্ত সর্বদা দৃশ্যমান। কদাচিৎ হয়ত স্থানীয়ভাবে মেঘ, বৃষ্টিপাতে দেখা যায় না। প্রতিদিন সূর্যের উদয়ে দিন শুরু হওয়ার ঐতিহ্যের পরেও ; বাংলাদেশের সরকারি বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের নামে গ্রেগরিয়ান রীতি অনুসরণ করে রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে দিনের সূচনাকালের নির্দেশনা দিয়েছে। সূর্যোদয় ঠিকমত দেখা না যাওয়ার কারণে, ১২ টা ১ মিনিট থেকে দিনের সূচনা ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোর জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও আমাদের জন্যে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক এবং অপ্রয়োজনীয় । 

কিন্তু এরপরেও "গরিবের ঘোড়া রোগ" প্রবাদের মত ইউরোপ আমেরিকার অন্ধ অনুসরণ করতে গিয়ে বাংলা একাডেমি বিষয়টি করেছে। বাংলা পঞ্জিকা গ্রেগরিয়ান রীতি অনুসরণ করে অপ্রয়োজনীয় সংস্কার প্রসঙ্গে মনে পড়ে কামিনী রায়ের বিখ্যাত  'অনুকারীর প্রতি' কবিতাটির কথা। কবিতাটিতে কবি কামিনী রায় পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মতাে যারা বলে এবং পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো যারা চলে তাদের তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছেন। তিনি পরের ধন চুরির মানসিকতা পরিত্যাগ করে, আপন মাঝে ডুব দিতে বলেছেন, তবেই অমূল্য খাঁটি ধনের সন্ধান মিলবে। 

"পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মতাে কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো কেন চলিস?
তাের নিজস্ব সর্বাঙ্গে তাের দিলেন দাতা আপন হাতে,
মুছে সেটুক 'বাজে' হলি, গৌরব কিছু বাড়ল তাতে?
আপনারে যে ভেঙে চুরে গড়তে চায় পরের ছাঁচে
অলীক, ফাঁকি, মেকি সে-জন, নামটা তার ক'দিন বাঁচে?
পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যা রে
খাঁটি ধন যা সেথাই পাবি আর কোথাও পাবি না রে।"

বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকাকে সংস্কারের দায়িত্বে সব সময়ই ছিল বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কারের জন্য পাকিস্তানি শাসনকালে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে "বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার" নামে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির সংস্কারের প্রধান বিষয়গুলো ছিল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের পরিধি মাপের প্রচলিত রীতি পরিবর্তন করে গ্রেগরিয়ান বা খ্রিস্টিয় রীতি অনুসরণ করে রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে দিনের সূচনাকাল হিসেবে গণ্য করা।

অথচ আমাদের প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে একটি দিন শুরু হওয়ার রীতি।সূর্যকে দেখতে হলে আবহাওয়া, কুয়াশা, আকাশের মেঘের উপরে সর্বদা যে সকল দেশকে নির্ভর করতে হয় তাদের জন্যে হয়ত ১২ টা ১ মিনিটে নতুন দিনের শুরু হওয়ার তত্ত্বটি প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই প্রয়োজনীয়। প্রতিদিন সূর্যোদয়ে আমাদের ঘরকে আলোকিত করে নতুন একটি দিনের শুরু হয়। সে প্রেক্ষাপটে নৈসর্গিক পরিবর্তন বিহীন ঘড়ির কাঁটায় বেঁধে দেয়া সময়ে দিনরাত্রি সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি আমাদের সংস্কৃতির জন্যে একেবারেই যৌক্তিক নয়।

১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ পাকিস্তান সরকারের সময়ে করা সংস্কারকৃত খাতাবন্দী পঞ্জিকাকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিলে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়, সাথে গ্রেগরিয়ান বা খ্রিস্টিয় রীতি অনুসরণ করে রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে দিনের সূচনাকাল হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া পঞ্জিকাকে অনুসরণ না করে আবহমান পঞ্জিকাকেই অনুসরণ করে আজও চলছে। 

সূর্যের বিভিন্ন প্রাকৃতিক হেঁয়ালির জন্যে রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে শ্বেতরাত্রির উপস্থিতি দেখা যায়।১১ জুন থেকে ২ জুলাই সময়টাতে সেখানে স্থানীয় সময় যখন মাঝরাত, তখন গোধূলীর আলো প্রত্যক্ষ করা যায়।শ্বেতরাত্রি আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটি নিশীথ সূর্যের মতোই একটি বাস্তব নৈসর্গিক বিস্ময়কর ঘটনা। সুমেরুবৃত্ত বা কুমেরুবৃত্ত থেকে কিছুটা আগে, নিরক্ষরেখা থেকে ষাট ডিগ্রী চৌত্রিশ মিনিট অক্ষাংশের একটু পরে অবস্থিত স্থানগুলোতে গ্রীষ্মকালে মধ্যরাতে সূর্য না দেখা গেলেও মধ্যরাতে গোধূলীর (Midnight Twilight) দেখা মেলে।

এ স্থানগুলো হল দিগন্ত থেকে ৬ বা ৭ ডিগ্রী নিচে । সারারাত গোধূলীর আকাশের মতোই সেখানে মৃদু সূর্যের আলো থাকে। এ আলোয় পড়াশোনা সহ সকল কাজ দিনের আলোর মত করা যায়। 
আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি, ২১ ফেব্রুয়ারির দিনে সকালবেলার প্রভাতফেরিতে ফুল নিয়ে খালি পায়ে শহীদ মিনারে শহীদদের শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে যেতাম। অন্য রকমের একটা অনুভূতি হত দেহ-মনে। কিন্তু বর্তমানে রাত্রিতে ফুল দিতে গিয়ে প্রভাতফেরিকে আমরা রাত্রিফেরি বানিয়ে ফেলেছি। এভাবেই আমরা আমাদের সংস্কৃতির সৌন্দর্যকে ঐতিহ্যকে পরিবর্তন করে ফেলছি।

যতদূর শুনেছি, ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ রাত্রিফেরি শুরু হয়, সামরিক শাসনামলে আশির দশকের শেষদিকে। সকালে ফুল দিতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসককে অপদস্ত করবে, এ কারণে তিনি গভীর রাত্রেই ফুল দেয়ার প্রথা প্রচলন করেন। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আমরাও মধ্যরাত্রে শহীদবেদিতে ফুল দিয়ে শেষরাত্রে বাসাতে পৌঁছে ঘুমিয়ে যাই। সকালে উঠে শহীদবেদিতে ফুল দেয়া আর হয়না। এবং এভাবেই হারিয়ে ফেলেছি, ২১ ফেব্রুয়ারির দিনে ঐতিহ্যবাহী প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করা আমাদের নস্টালজিক সকালটা। 

নিজেদের অজান্তে এভাবেই ধীরেধীরে হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জাতিগত স্বাভিমান; শুধু অন্ধের মত অন্যের অনুকরণে। বিদেশীদের অন্ধের মত অনুকরণ করতে নিষেধ করে, তাদের থেকে শুধু প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞানটি গ্রহণ করতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, জ্ঞানের প্রথম প্রভাত এ ভূখণ্ডের বনভবন থেকেই হয়েছে। সে তপবন বনভবনের চিরকল্যাণকর জ্ঞানই আজ দেশ-বিদেশে বিতরিত হয়ে জগত ধন্য হচ্ছে।

"প্রথম প্রভাত উদয় তব গগনে, 
প্রথম সামরব তব তপোবনে,
প্রথম প্রচারিত তব বনভবনে 
জ্ঞানধর্ম কত কাব্যকাহিনী।
চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য, 
দেশবিদেশে বিতরিছ অন্ন,
জাহ্নবীযমুনা বিগলিত করুণা 
পুণ্যপীষুষস্তন্যবাহিনী॥"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন