ভালবাসার শক্তি | শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

ভালবাসার শক্তি | শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, ভালবাসা কি


ভালবাসা যখন পূর্ণ হয়, তখন এ পূর্ণতাই নিয়ে আসে বিচ্ছেদ। ফলের বীজ যত পূর্ণ হতে থাকে, পরিপক্ব হতে থাকে, ততই তার বাইরের আবরণ ম্লান হয়ে যেতে থাকে। আদরের সাময়িক বিরতিতে তীব্র হয়, পূর্ণ হয়, রঙিন হয় এবং গন্তব্যে পৌছায় ভালবাসা। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধের বিখ্যাত শতকত্রয়ের রচয়িতা কবি ভর্তৃহরি তাঁর 'শৃঙ্গারশতক' কাব্যে বলেন:

যদ্যস্য নাস্তি রুচিরং তস্মিংস্তস্য স্পৃহামনােজ্ঞেঽপি।
রমণীয়েঽপি সুধাংশৌ ন মনঃকামঃ সরােজিন্যাঃ॥
(শৃঙ্গারশতক:১০৪)

"যে বস্তু যার প্রীতিকর নয়, অতি মনোহর হলেও সে বস্তুতে তার কোন সামান্যতম আকাঙ্ক্ষা থাকে না।চন্দ্র অত্যন্ত রমনীয় হলেও, সুদর্শন চন্দ্রের প্রতি পদ্মের অন্তরের থেকে কোন আকর্ষণ নেই।"

এমনি তীব্রতর ভালবাসার গল্পের মহিমান্বিত নায়ক হলেন দশরথ মাঝি।দশরথ মাঝি ১৯২৯ খ্রিস্টব্দের ১৪ ই জানুয়ারি ভারতের বিহারের গয়ার নিকটে গহলৌর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন ঘাটশ্রমিক ছিলেন। কিশোর বয়সে তিনি পাটনার মোকামা ঘাটের শাখায় অবস্থিত সন্ত কবিরপন্থী নিরামিষাশী ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তাঁর স্ত্রী ফাল্গুনী বা ফাগুনি দেবী অসুস্থ অবস্থায় পাহাড় অতিক্রম করতে গিয়ে পাহাড় থেকে পরে গিয়ে আহত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। স্ত্রীর এ মৃত্যু দশরথ মাঝিকে এক অন্য মানুষে পরিণত করে। তার দৃঢ় মনবল থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন যে পাহাড়কে অতিক্রম করতে গিয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছে; তিনি সেই সেই পাহাড় কেটে সবার জন্যে একটি রাস্তা তৈরি করবেন। যেই কথা সেই কাজ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ১১০ মিটার দীর্ঘ (৩৬০ ফুট) প্রশস্ত, ৯.১ মিটার (৩০ ফুট) এবং ৭.৭ মিটার (২৫ ফুট) গভীরত্বকে কেটে একটি রাস্তা তৈরি করবেন। পাহাড়গুলি কেবল একটি হাতুড়ি এবং ছেনি ব্যবহার করে ২২ বছর কাজ করার পরে, দশরথ মাঝি পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ রাস্তাটি তৈরি করতে সক্ষম হন। তাঁর এ অনন্য কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সম্মাননা পেয়েছিলেন। ভারত সরকারের ডাক বিভাগ ২০১৬ সালে তাঁর স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে মরণোত্তর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন, 'মাউন্টেনম্যান' নামেও খ্যাত এই মহান প্রেমিক দশরথ মাঝি। 

ভারতের বিহার রাজ্যের গয়া জেলার মুহরা তহশিলের আতরি ব্লকে অবস্থিত প্রত্যন্ত গ্রাম গেহলৌর। গ্রামটিকে পাশের শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বড় এক পাহাড়, তাঁর নামও গেহলৌর। পাহাড় ঘুরে ওয়াজিরগঞ্জ যেতে গ্রামবাসীকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৫৫ কিলোমিটার পথ। গ্রামের উন্নয়নের পথেও একদিন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গেহলৌর পাহাড়।১৯৫৯ সালের কোনো এক দুপুরের। সেদিনও সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে ছিল। স্ত্রী ফাল্গুনীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন দশরথ মাঝি। ফাল্গুনির আসতে দেরি হওয়ায় চিন্তিত দশরথ মাঝিঁ জানতে পারেন তাঁর জন্যে খাবার নিয়ে আসার সময়ে প্রিয়তমা স্ত্রী ফাল্গুনী পাহাড়ে পা পিছলে পড়ে প্রচণ্ড আহত হয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় ফাল্গুনীকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বিধি বাম, ৭০ কিলোমিটার দূরে হাসপাতালে।গরুর গাড়ি করে হাসপাতালে নেয়ার সময় দশরথের কোলেই মারা যান, প্রিয়তমা স্ত্রী ফাল্গুনি। এলোমেলো হয়ে যায় দশরথের জীবন। হারিয়ে যায় রুক্ষ পাহাড়ি গ্রামীণ জীবনের একমাত্র ভালবাসার ঝর্ণাধারাটুকু। 

সতি প্রদীপে সত্যগ্নৌ সৎসু তারামনীন্দুষু। 
বিনা মে মুগশাবাক্ষ্যা তমােভূতমিদং জগৎ ॥
(শৃঙ্গারশতক:১৪)

"প্রদীপ, অগ্নি, নক্ষত্র, পদ্মরাগাদি মণি ও চন্দ্র বিদ্যমান থাকলেও বালহরিণের মত নয়ন যার সেই রমণীভিন্ন এই জগৎ আমার কাছে অন্ধকারময়।"

সমস্ত রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে নিস্প্রাণ পাহাড়ের ওপর। ঘরের ছাগল বিক্রি করে দিয়ে কিনলেন হাতুড়ি আর শাবল। পাহাড়ের জন্যে যেন আর কারো প্রাণ ত্যাগ করতে না হয় এ প্রতিজ্ঞা করলেন। নিতে দেবো না। কেউ তাঁর থাক বা না থাক তিনি একাই বানাবেন পাহাড় কেটে রাস্তা। যাতে গ্রামের মানুষ দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে।১৯৬০ সাল, এক ভোরে সূর্য ওঠার আগে দশরথ মাঝিঁ নেমে পড়েন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অসম লড়াইয়ে। হাতুড়ির ঘায়ে পাহাড়ের পাথরে দশরথ মাঝির ক্ষোভের ফুলকি ঠিকরে ওঠে। হাতুড়ির প্রতিটি আঘাত যেন, স্ত্রী ফাল্গুনীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর এক প্রতিশোধ।পাথর কাটা মেশিন নেই, হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে বানাবে রাস্তা -এই বলে হাসি-ঠাট্টা  করতে লাগলেন গ্রামবাসী। কিন্তু দশরথ তার প্রতিজ্ঞায় অটুট থাকেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পরবর্তীতে বলেছিলেন, "আমি যখন পাহাড় হাতুড়ি শুরু করলাম তখন লোকেরা আমাকে পাগল বলে উপহাস করেছিল, কিন্তু আমি আমার সংকল্পে দৃঢ়স্থির ছিলাম।যদিও বেশিরভাগ গ্রামবাসী প্রথমে আমাকে কটূক্তি পরিহাস করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে গ্রামবাসী তাদের ভুল বুঝতে পারে। এদের মধ্যে কিছু লোক ছিল যারা আমাকে খাবার সরবরাহ করে, পাহাড় কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে সর্বাত্মক সহায়তা করে।"

এভাবে কেটে গেল দশটি বছর। গ্রামের লোক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন, পাহাড়ের গায়ে এই দশ বছরে বড় একটা ফাটল বানিয়ে ফেলেছেন দশরথ। ফাটলটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। রোদ ঝড় বৃষ্টিতে গ্রামের সবাই যখন ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে, তখন দশরথ মাঝি অবিরাম গতিতে চালিয়ে যান হাতুড়ি। এভাবেই কেটে যায় ২২ বছর। ১৯৮২ সালে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়। অপলক দৃষ্টিতে নিজের সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দশরথ মাঝিঁ। মনে পরে যায় প্রিয়তমা স্ত্রী ফাল্গুনীর স্মৃতি। দশরথ মাঝির স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভালবাসার কাছে পরাজিত হয় দুর্গম পাহাড়। গেহলৌর গ্রামবাসী অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করে ভালবাসার শক্তি। ভালবাসায় সব হয়। এ কারণেই ভর্তৃহরি তাঁর 'শৃঙ্গারশতক' কাব্যে বলেছেন, অস্তিচর্মসার, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ না থাকলেও, দেহে দুর্গন্ধযুক্ত পচন ধরা, বয়সের ভারে জীর্ণশীর্ণ যে মাথা তুলতে পারে না এমন একটি কুকুরও কুকুরীও একে অন্যকে অনুসরণ করে তাদের মধ্যেকার ভালবাসা পেতে চায়। সামান্য কুকুর যদি ভালবাসার এতটা কাঙাল হয়, তবে মানুষের কথা আর কিই বা বলার আছে।

কুশঃ কাণঃ খঞ্জঃ শ্রবণরহিতঃ পুচ্ছবিকলাে 
ব্রণী পূয়ক্লিন্নঃ কৃমিকুলশতৈরাবৃততনুঃ।
ক্ষুধাক্ষামাে জীর্ণঃ পিঠরককপালার্পিতগলঃ
 শুনীমন্বেতি শ্বা হতমপি চ হন্ত্যেব মদনঃ॥
   (শৃঙ্গারশতক:৮০)

" অস্থিচর্মসার, একচক্ষুযুক্ত, একপাদবিশিষ্ট, শ্রবণশক্তিবিহীন, লেজবিহীন, ক্ষতযুক্ত, পুঁজসিক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত শত শত কীটে আচ্ছাদিত দেহ, ক্ষুধার্ত, বয়সের ভারে জীর্ণ, কলসীর কানায় গলদেশ বেষ্টিত-এরূপ কুকুর কুকুরীও একে অন্যকে অনুসরণ করে। কামদেব অর্ধমৃত জীবকেও প্রেমরূপ কামনার জালে বিদ্ধ করতে দ্বিধাবােধ করেন না।"

আমরা মহাভারতেও এ সুতীব্র ভালবাসার অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাই। যা নিয়ে পরবর্তীকালে কবি কালিদাস সহ অসংখ্য সংস্কৃত কবিরা কাব্য এবং নাটক রচনা করেছে। চন্দ্রবংশীয় রাজা দুষ্মন্ত এবং তাঁর স্ত্রী শকুন্তলার অনন্য স্বর্গীয় ভালবাসার কাহিনী নিয়ে মহাকবি কালিদাস 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম্' নামে জগদ্বিখ্যাত একটি নাটক লিখেছেন। কাহিনীটি শুরু হয় প্রচণ্ড নাটকীয়তা দিয়ে।রাজা দুষ্মন্ত  মৃগয়ায় এসে একটি হরিণকে তাড়া করতে করতে কণ্বমুনির আশ্রম তপোবনে এসে উপস্থিত হন। এখানেই রাজা দুষ্মন্তের কণ্বমুনির পালিতা কন্যা শকুন্তলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতেই তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে যান। পরবর্তীতে সেই আশ্রমেই তাদের মালাবদলের মাধ্যমে গান্ধর্ববিবাহ সম্পন্ন করে মিলিত হন। এরপর জরুরি কাজে দুষ্মন্তকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হয়। যাওয়ার আগে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে একটি রাজকীয় অঙ্গুরীয় দিয়ে যান এবং কথা দেন যে আবার ফিরে আসবেন। শকুন্তলার গর্ভবতী হয়ে পড়ে। দুর্বাসা মুনির শাপে রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে ভুলে যান। এরপরে বহু চড়াই-উতরাই পার করে শকুন্তলা তাঁর প্রিয়তম স্বামীকে কাছে পান। শকুন্তলার গর্ভেই  একটি মহাপ্রতাপশালী সন্তানের জন্ম হয়, যার নাম 'ভরত'। এই ভরতের থেকেই এই ভূখণ্ডের  ভারতবর্ষ নামকরণ হয়ে দুষ্মন্ত এবং শকুন্তলার  ভালবাসার চিহ্ন আজও বহন করে যাচ্ছে।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন