নিত্যকর্ম বলতে সনাতনধর্ম অনুসারে সেই কর্ম বা আচারকে বোঝায় যা প্রতিদিন সম্পাদন করা প্রয়োজন। এটি বাধ্যতামূলক বৈদিক কর্তব্যকে বোঝায় যা দৈনন্দিন অনুশীলনের জন্য নির্ধারিত হয়। এটি হল নিসিদ্ধকর্ম ও কাম্যকর্ম সহ মীমাংসা দর্শন দ্বারা শ্রেণীবদ্ধ তিনটি আচারিক কর্মের মধ্যে একটি এটি শৈবসিদ্ধান্ত দর্শনেও বৈশিষ্ট্যযুক্ত।
নিত্যকর্ম হলো পরম পবিত্র কর্ম, আর শরীরই হচ্ছে ধর্মের মূল আধার - 'শরীরম্ আদ্যং খলু ধর্মসাধনম্'। এটি দুটি সংস্কৃত শব্দ নিয়ে গঠিত- নিত্য (সর্বদা) ও কর্ম (আচরণ বা কর্তব্য)। এটির অর্থ শুধু দৈনন্দিন কর্তব্য নয়, এতে নিয়মিত বা পর্যায়ক্রমিক নির্ধারিত কার্যক্রম বা দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
শ্রেণীবিভাগ
শাস্ত্রে নিত্যকর্মসমূহকে ছয় ভাগে ভাগ করেছে। যথা: প্রাতঃকৃত্য, পূর্বাহ্ণকৃত্য, মধ্যাহ্নকৃত্য, অপরাহ্নকৃত্য, সায়াহ্নকৃত্য ও রাত্রিকৃত্য।
প্রাতঃকৃত্য
সূর্য ওঠার পূর্বে বা আগে ঘুম থেকে উঠে বিছানার উপরে পূর্ব বা উত্তর দিকে মুখ করে বসতে হয়। এরপর ঈশ্বর বা দেব-দেবীদের স্মরণ করে মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
প্রাতঃকৃত্য মন্ত্রসমূহ
বিছানায় বসে:
অতপর পূর্বমুখী হয়ে মাটি স্পর্শ করে: ওঁ প্রিয়দত্তায়ৈ ভূম্যৈ নমঃ।
ঘর থেকে বের হয়ে:
পূর্বাহ্ণকৃত্য
প্রাতঃকৃত্যের পরে এবং দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত যেসব কাজ করা হয় তাই পূর্বাহ্ণকৃত্য। পূর্বাহ্ণকৃত্যসমূহ হলো: প্রার্থনা, উপাসনা ও পূজা।
প্রার্থনামূলক মন্ত্র
হিন্দুধর্মে অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, ভগবদ্গীতা, শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বরের স্তব ও প্রার্থনামূলক অনেক মন্ত্র ও শ্লোক রয়েছে।
বেদের মন্ত্র
ঋগ্বেদ
সর্বলোকের প্রকাশক সর্বব্যাপী সবিতা মণ্ডল জগৎ প্রসবকারী সেই পরম দেবতার বরেণ্য জ্ঞান ও শক্তি ধ্যান করি; যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রদান করেছেন। — গায়ত্রী মন্ত্র, ঋগ্বেদ ৩.৬২.১০
পরম পুরুষ বা ঈশ্বরের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি জগৎকে সর্বত্র অতিক্রম করে দশ অঙ্গুলি পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে অবস্থান করেন। — ঋগ্বেদ, ১০.৯০.১
যজুর্বেদ
হে ঈশ্বর, আমাকে এমন দৃঢ় কর যাতে সকল প্রাণী আমাকে বন্ধুর চোখে দেখে। আমিও তাদের বন্ধুর চোখে দেখি। আমরা সকলেই যেন পরস্পরকে বন্ধুর চোখে দেখি। — শুক্ল যজুর্বেদ ৩৬.১৮
উপনিষদ
বৃহদারণ্যক উপনিষদ
অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যাও। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাও। মৃত্যু থেকে আমাদের অমরত্বের দিকে নিয়ে যাও। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি। — পবমন মন্ত্র, বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৩.২৮
ঈশোপনিষদ
ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু অনিত্য বস্তু আছে, তা ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত। উত্তমরূপ ত্যাগের সঙ্গে ভোগ করবে, কারও ধনে লোভ করবে না। — ঈশোপনিষদ, স্তোত্র ১
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ
যা থেকে উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই, যা থেকে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই, যে অদ্বিতীয় পরমাত্মা বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চলভাবে স্বমহিমায় বিরাজিত, সেই পরমপুরুষের দ্বারাই সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত। — শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ৩.৯
গোপালতাপনী উপনিষদ
হে কেশব, হে ক্লেশ বিনাশকারী, হে নারায়ণ, হে জনার্দন, হে গোবিন্দ-পরমানন্দ, হে মাধব আমাকে উদ্ধার কর। — গোপালতাপনী উপনিষদ, ১৭
ভগবদ্গীতা
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে ।
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি ।।
এই জগতে জ্ঞানের তুল্য পবিত্র আর কিছু নেই। যোগসিদ্ধগণ যথাসময়ে সে জ্ঞানকে নিজ আত্মাতে অনুভব করেন। — ভগবদ্গীতা, ৪.৩৮
পরবর্তী শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে,
শ্রদ্বাবান, একনিষ্ঠ এবং জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করে থাকেন। জ্ঞান লাভ করার পর শীঘ্র তিনি পরম শান্তি পেয়ে থাকেন। — ভগবদ্গীতা, ৪.৩৯
শ্রীশ্রীচণ্ডী
প্রার্থনামূলক মন্ত্র হিসেবে শ্রীশ্রীচণ্ডীর উল্লেখযোগ্য স্তোত্রগুলো নিন্মে দেয়া হলো:
হে দেবী শিবের পত্নী সকল মঙ্গলে তুমি মঙ্গল স্বরূপা, কল্যাণদাত্রী, সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী, আশ্রয়দাত্রী, ত্রিনয়না, গৌরবর্ণা, নারায়ণী তোমাকে প্রনাম জানাই। — শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১১.৩৭
তুমি সর্বস্বরূপা দেবী, তুৃমি স্বর্গ এবং মুক্তি দান করে থাক। কাজেই তোমাকে স্তব করতে হলে কোন শ্রেষ্ঠ বা পরম বাক্য তোমার স্তবের জন্য যোগ্য হবে। — শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১১.৩৭
মধ্যাহ্নকৃত্য
পূর্বাহ্ণের পরে অর্থাৎ স্নান, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া এবং বিশ্রাম করা হলো মধ্যাহ্নকৃত্য।
মধ্যাহ্নকৃত্য মন্ত্রসমূহ
স্নান মন্ত্র (যেকোনো সময়)
স্নানের সময়
বিশ্রাম নেয়ার মন্ত্র
অপরাহ্নকৃত্য
দুপুরের পর এবং সায়াহ্নের পূর্ব পর্যন্ত যে কাজ করা হয়, তাকেই অপরাহ্নকৃত্য বলা হয়। এ সময়ে বিনোদনমূলক কাজ করা উচিত।
সায়াহ্নকৃত্য
সায়াহ্ন মানে সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হয়। তারপর স্তব-স্তুতি বা ভক্তিমূলক গান গেয়ে ঈশ্বরের উপাসনা করতে হবে।
রাত্রিকৃত্য
সন্ধ্যার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কাজকে রাত্রিকৃত্য বা নৈশকৃত্য বলা হয়। এ সময় অধ্যায়ন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করা হয়। তারপর ঘুমাতে হয়।
রাত্রিকৃত্য মন্ত্রসমূহ
শয়নের পূর্বে মন্ত্র
ঘুমানোর সময়ে:
কর্মসমূহ
হিন্দুধর্মে নিত্যকর্মের তালিকা ও পদ্ধতি সম্প্রদায়ের উপর নির্ভরশীল। নিন্মে নিত্যকর্মের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
স্নানযাত্রা: স্নান (অভিষেক) ; যে দেবতার উপাসনা করা হয় তাঁর স্নান করানো।
সন্ধ্যাবন্দনা: দিনের উদ্বোধনী ও বন্ধের সময়ে সম্পাদিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সন্ধ্যাবন্দনা বাধ্যতামূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুদের দ্বিজ সম্প্রদায় দ্বারা করা উচিত।
উপাসনা: বৈবাহিক আগুন জ্বলন্ত রাখা। উপাসনা হল একটি যজ্ঞ যা বিবাহীত দীক্ষিত হিন্দুদের দ্বারা প্রতিদিন সম্পাদিত হয়।
প্রার্থনা: প্রার্থনা হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়; এটি হিন্দু উপাসনার সময় অনুশীলন করা হয় এবং এটি ভক্তি প্রকাশ। মন্ত্র জপ হিন্দুধর্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপাসনা। যোগ ও ধ্যানকেও ভক্তিমূলক সেবার রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অগ্নিহোত্র: উত্তপ্ত দুধের নৈবেদ্য। অগ্নিহোত্র কঠোর রীতি অনুসারে পবিত্র আগুনে ঘি ঢালার যজ্ঞকে বোঝায়, এবং শরৌত ঐতিহ্য অনুসারে তাদের দ্বারা প্রতিদিন দুবার উত্তপ্ত দুধের নৈবেদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
দেবতার্চনা: পূজা ; গৃহে বা মন্দিরে নিত্যপূজা, উৎসব উপলক্ষে বিশেষ পূজা অথবা যাত্রা বা কার্যারম্ভের পূর্বে কৃত পূজা ইত্যাদি।
প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থের লেখক, পরাশরের মতে, ছয়টি কাজকে নিত্যকর্ম বলে গণ্য করা হয়:
- স্নান (দেহ পবিত্রকরন)
- সন্ধ্যাবন্দনম্ (সকাল ও সন্ধ্যার প্রার্থনা)
- বেদের আবৃত্তি
- পূর্বপুরুষদের পূজা
- হোম (আগুনের নৈবেদ্য)
- তর্পণ (দেবতাদের পূজা)
পঞ্চ নিত্যকর্ম
পঞ্চ নিত্যকর্ম সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ, "প্রত্যেক হিন্দুর পাঁচটি চিরস্থায়ী কর্তব্য।" এই মহৎ ধর্মীয় নীতি অনুসারে জীবন যাপন করে, আমরা আমাদের ধর্মীয় জীবনকে আধ্যাত্মিক করি এবং আমাদের নিজস্ব ঐশ্বরিক স্বরূপ উপলব্ধি করি। পঞ্চ নিত্যকর্মগুলো হলো:
- উপাসনা: বাড়িতে বা মন্দিরে বেদীতে পূজা।
- উৎসব: পবিত্র দিন।
- ধর্ম: পুণ্যময় জীবন যাপন।
- তীর্থযাত্রা: দর্শনের মাধ্যমে পবিত্র ব্যক্তিদের কাছ থেকে আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা লাভের লক্ষ্যে শিশুদের পবিত্র স্থান ও মন্দিরগুলিতে তীর্থযাত্রা করার মূল্য প্রকাশ করা হয়।
- সংস্কৃতি: আচার ও উত্তরণের আচার।