বেদান্তবিজ্ঞানই জীব মুক্তির উপায় | শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, বেদান্ত, উপনিষদ, বেদান্ত মুক্তি


ভারতীয় পরম্পরার বৈশিষ্ট্যই হলো কোন বিষয় যেমন খুব বড় কাঠামোতে থাকে ঠিক তেমনিভাবে অতি ক্ষুদ্র কাঠামোতে সূত্রাকারেও থাকে। যজ্ঞ কর্মের বিধানগুলো শতপথ ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মতো বৃহৎ বৃহৎ ব্রাহ্মণগুলোতে যেমন বিস্তারিতভাবে দেয়া আছে। ঠিক তেমনি এ বিধানগুলোই আছে বিভিন্ন শ্রৌতসূত্রগুলোতে সূত্রাকারে সংক্ষিপ্তভাবে। বেদান্তে যে জ্ঞানের কথা আছে তাই আছে বেদান্তসূত্রে। যা আমাদের কাছে ব্রহ্মসূত্র নামে প্রচলিত। এর অন্য নাম ব্যাসসূত্র, ভিক্ষুসূত্র, শারীরিকসূত্র, বাদরায়ণসূত্র ইত্যাদি।

আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে বেদ দুটি কাণ্ডে বিভক্ত- কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা জ্ঞানকাণ্ড। কিন্তু প্রচলিত এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বেদ অর্থই জ্ঞান। সর্বপ্রকার জ্ঞান যা জীবকে নিঃশ্রেয়স এবং অভ্যুদয় দুই দান করে। অভ্যুদয়ের মাধ্যমে আমরা জাগতিক সমৃদ্ধি লাভ করি এবং নিশ্রেয়সের মাধ্যমে আমরা মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ ও কৈবল্য লাভ করি। যদিও বেদ মানে জ্ঞান এবং বেদবিদ্যার সর্বস্থানেই জ্ঞানতত্ত্ব আছে। বেদে বেদান্ত বা ব্রহ্মতত্বকে 'বেদান্তবিজ্ঞান' নামে অভিহিত করা হয়েছে:
বেদান্তবিজ্ঞান-সুনিশ্চিতার্থাঃ
সংন্যাস যোগাদ্যতয়ঃ শুদ্ধসত্ত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকে তু পরান্তকালে
পরামৃতাৎ পরিমুচ্যন্তি সৰ্বে ॥
দহ্রং বিপাপং পরমেশ্মভূতং
যৎ পুণ্ডরীকং পুরমধ্যসংস্থম্।
তত্রাপি দহ্রং গগনং বিশোকস্
তস্মিন্ যদন্তস্তদুপাসিব্যম্ ॥
যো বেদাদৌ স্বরঃ প্রোক্তো
বেদান্তে চ প্রতিষ্ঠিতঃ।
তস্য প্রকৃতিলীনস্য
যঃ পরঃ স মহেশ্বরঃ।।
(মহানারায়ণ উপনিষদ:১২.১৫-১৭)

"বেদান্তজনিত বিজ্ঞানের বিষয় পরমাত্মা যাঁদের নিকট সুনিশ্চিত হয়েছে; সন্ন্যাস যোগাবলম্বনে যাঁরা বিশুদ্ধচিত্ত হয়েছেন এবং যাঁরা মোক্ষসাধনে যত্নশীল, তাঁরা সকলে জীবদ্দশায়ই পরমাত্মভূত হওয়ায় মর দেহ ত্যাগ কালে সর্বত্র নির্বাণ প্রাপ্ত হন। সাধারণ লোকের দেহত্যাগের পর—অন্তকাল নহে, কারণ তারা পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। মুক্তপুরুষ অন্যলোকে গমন করেন না। যেমন ঘট ভঙ্গ হলে ঘটাকাশ মহাকাশে একীভূত হয়; সেইরূপ তিনি সর্বব্যাপী ব্রহ্মে লীন হন।

অল্প, পাপরহিত, পরমাত্মার উপলব্ধিস্থানভূত, শরীরের মধ্যে অবস্থিত অষ্টদল পদ্ম বিদ্যমান। সেই ক্ষুদ্র পদ্মে সূক্ষ্ম আকাশের ন্যায় অমূর্ত ব্রহ্ম বিরাজিত। যদিও ব্রহ্ম ব্যাপক, তবু ঘটাকাশ তুল্য পদ্মস্থানকে উপলক্ষ করে অল্প বলা হয়েছে। ব্রহ্ম শোকমুক্ত, আকাশ শব্দবাচ্য, সেই পদ্মমধ্যে ব্রহ্মতত্ত্বের উপাসনা করবে।

‘অগ্নিমীলে পুরোহিতম্’ ইত্যাদি বেদের আদিতে যে প্রণব রূপ বর্ণ উক্ত হয়েছে, সেই প্রণব ধ্যানকালে অব্যাকৃত জগৎকারণে লীন হয়। অকার, উকার ও মকারে যথাক্রমে বিরাট্, হিরণ্যগর্ভ ও অব্যাকৃতরূপে ধ্যান করে অকার বিরাটকে উকারে লয় করে পরে হিরণ্যগর্ভরূপ উকারকে মূল প্রকৃতিরূপ মকারে লয় করবে। সেই প্রকৃতিলীন প্রণবের যে উৎকৃষ্ট ধ্যাতব্য বস্তু, তাকেই মহেশ্বররূপে জানবে। এর দ্বারা পূর্বোক্ত গগনশব্দবাচ্য বস্তু স্থিতভাবে বলা হলো।"

বেদের জ্ঞানকাণ্ডের শেষ অংশকে অর্থাৎ উপনিষদকে সাধারণত বেদান্ত বলা হয়ে থাকে। উপনিষদগুলো বেদের কোন না কোন অংশের সাথে যুক্ত। কোনটি সংহিতার সাথে, কোনটি ব্রাহ্মণের সাথে, কোনটি আরণ্যকের অথবা কোনটি পরম্পরাগতভাবে যুক্ত।আরণ্যকে যে অধ্যাত্মবিদ্যার সূচনা উপনিষদে তা চরম শিখরে পৌঁছে জ্ঞানরাজ্যের মুকুটমণিতে পরিণত হয়েছে। উপনিষদ শব্দের ব্যুৎপত্তি হলো উপ-নি+সদ্+ক্বিপ্ =উপনিষধদ। ‘উপ’ অর্থ নিকটে। ‘নি’ অর্থ নিশ্চিতভাবে। ‘সদ্’ অর্থ বিনাশ করা। অর্থাৎ ব্যুৎপত্তিগতভাবে উপনিষদ শব্দের অর্থ হল আচার্যের নিকট উপস্থিত হয়ে নিশ্চয়ের সাথে বেদবিদ্যা অনুশীলনের মাধ্যমে অজ্ঞান-অবিদ্যার যা বিনাশ করে তাই উপনিষদ। উপনিষদ ১৪টি।ঋগ্বেদের ঐতরেয় উপনিষদ এবং কৌষীতকি বা শাংখ্যায়ন উপনিষদ।সামবেদের ছান্দোগ্য উপনিষদ এবং কেন ‘উপনিষদ।কৃষ্ণযজুর্বেদের-কঠ উপনিষদ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, মৈত্রায়নী উপনিষদ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ এবং মহানারায়ণ উপনিষদ।শুক্লযজুর্বেদের- ঈশ উপনিষদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ।পরিশেষে অথর্ববেদের প্রশ্ন উপনিষদ, মণ্ডুক উপনিষদ এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদ।

এ উপনিষদগুলো ব্যতীত অন্য যেসব উপনিষদ আছে তা শুধু নামেই উপনিষদ। এর সাথে বেদের কোন রূপ সম্পর্ক নেই। বেদান্ত দর্শনের একটি বিখ্যাত প্রকরণ গ্রন্থ 'বেদান্তসারঃ'। অত্যন্ত জনপ্রিয় এ গ্রন্থটি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত হয়। এর রচয়িতা হলের শ্রীশঙ্করাচার্যের পরম্পরায় অদ্বৈত বৈদান্তিক সন্ন্যাসী শ্রীসদানন্দ যোগীন্দ্র সরস্বতী। গ্রন্থের শুরুতেই তিনি বেদান্তের সংজ্ঞায় বলেন:

বেদান্ত নাম-উপনিষৎপ্রমাণং তদুপকারীণি
শারীরকসূত্রাদীনি চ৷৷
(বেদান্তসারঃ : ৩)

"বেদান্ত হল—প্রত্যেক বেদের অন্তে অর্থাৎ চরম সিদ্ধান্ত হিসেবে ব্রহ্মাত্মপ্রতিপাদক উপনিষদের যে বাক্যরাশি রয়েছে; সেই উপনিষদের বাক্যের সহায়ক ব্রহ্মসূত্র, গীতা প্রভৃতিকে বেদান্ত বলে।"
‘বেদান্ত’ বললে যেমন শুধু উপনিষদকে বোঝায়, তেমনিভাবে ‘বেদান্তদর্শন’ বললে প্রস্থানত্রয়ীকে বোঝায়। ‘প্রস্থান’ বলতে চলে যাওয়া বোঝায়। কোথায় চলে যাওয়া? তত্ত্বেও চলে যাওয়া, ব্রহ্মের কাছে চলে যাওয়া। এ প্রস্থান অর্থাৎ ব্রহ্মের কাছে চলে যাবার পথ তিন প্রকার।এ কারণে তাকে প্রস্থানত্রয়ী বলা হয়। এ প্রস্থানত্রয়ী হল:

(১) শ্রুতি প্রস্থান : বেদ শ্রুতি পরম্পরায় রক্ষিত ছিল বহুদিন। তাই তাঁর এক নাম শ্রুতি। শ্রুতি প্রস্থান বলতে উপনিষদকে বোঝায় অর্থাৎ উপনিষদের অধ্যাত্মতত্ত্বের মাধ্যমে অমৃতময় ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থান করা।
(২) স্মৃতি প্রস্থান : বেদের জ্ঞানকাণ্ড উপনিষদের সারাংশ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে বলা হয় স্মৃতিপ্রস্থান।
(৩) ন্যায় প্রস্থান : ঋষি বাদরায়ণ রচিত ব্রহ্মসূত্র। যা চারটি অধ্যায়ে এবং ৫৫৫টি সূত্রে অখিল বেদবিদ্যাকে প্রকাশ করেছে। প্রথম অধ্যায়ে বেদবাক্যসমূহের সমন্বয়, দ্বিতীয় অধ্যায়ে অবিরোধ, তৃতীয় অধ্যায়ে সাধন এবং চতুর্থ অধ্যায়ে সিদ্ধি বা ফল বর্ণনা করে অনন্ত অধ্যাত্ম শাস্ত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ সংক্ষিপ্ত সূত্রশাস্ত্রের মাধ্যমে ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থিত হবার অনন্য পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে।

ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ এ চতুর্বিধ বেদর প্রত্যেকই সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদে বিভক্ত। তবে এরমধ্যে ব্যতিক্রম অথর্ববেদ। এর কোন আরণ্যক নেই। বিবিধ প্রকারে বিভক্ত হয়ে বিবিধ শাখাভেদে সমগ্র বেদমন্ত্র লক্ষাধিক। বিষয়টি আমরা সুস্পষ্টভাবে বিষ্ণুপুরাণের মধ্যে দেখতে পাই।
আদ্যো বেদশ্চতুষ্পাদঃ শতসাহস্রসম্মিতঃ ।
ততো দশগুণঃ কৃৎস্নো যজ্ঞোঽয়ং সৰ্বকামধুক্ ॥
ততোঽত্র মৎসুতো ব্যাসো হ্যষ্টাবিংশতিমেঽন্তরে ।
বেদমেকং চতুষ্পাদং চতুর্ধা ব্যভজং প্রভুঃ ॥
(বিষ্ণুপুরাণ :৩.৪.১-২)

"পরাশর বললেন,—ঈশ্বর হতে আবিভূর্ত ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ এ চতুর্বিধ ভেদসমন্বিত বেদ, লক্ষ মন্ত্র পরিমিত। এ বেদমন্ত্র হতে সর্বপ্রকার কামনাপূরক অগ্নিহোত্র প্রভৃতি দশটি যজ্ঞ প্রবর্তিত হয়েছে। এরপরে অষ্টাবিংশতিতম দ্বাপরযুগে সেই চতুষ্পাদ বেদকে একীভূত দেখে আমার পুত্র ধীমান ব্যাসদেব পূর্বের ন্যায় পুনরায় বেদকে চারভাগে বিভক্ত করলেন।"
বেদান্তদর্শন বা প্রস্থানত্রয়ীর দিকে তাকালে আমরা দেখি বেদের লক্ষ লক্ষ মন্ত্রকে সারাংশ করে নিয়ে আসা হয়েছে বেদের জ্ঞানকাণ্ড উপনিষদে। লক্ষ লক্ষ মন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রায় দু’সহস্র মন্ত্রে; অর্থাৎ চতুর্দশ উপনিষদে। উপনিষদের প্রায় দু’সহস্র মন্ত্রকে নিয়ে আসা হয়েছে সহজ, সরল, সর্বজনগ্রাহ্য করে মাত্র ৭০০ শ্লোকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়। এ কারণে গীতাকে সর্ব উপনিষদের সার বলা হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এ ৭০০ শ্লোককে পরবর্তী কালে আরও সংক্ষেপ করে নিয়ে আসা হয়েছে ব্রহ্মসূত্রে। মাত্র ৫৫৫টা সূত্রে। দু-তিনটি শব্দের এক একটি সূত্রে। এ ৫৫৫টা সূত্রে বলা বেদান্তদর্শনের তত্ত্বকে আবার বলে দেয়া হয়েছে প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাদের চারটি সূত্রে। এ সূত্রগুলোকে একসাথে বলা হয় ‘চতুঃসূত্রী’। শ্রীমদ্ভগবদগীতার মধ্যে আমরা ন্যায় প্রস্থান ব্রহ্মসূত্রের উল্লেখ পাই:
ঋষিভিবহুধা গীতং ছন্দোভিৰ্বিবিধৈঃ পৃথক্‌।
ব্রহ্মসূত্রপদৈশ্চৈব হেতুমদ্ভিৰ্বিনিশ্চিতৈঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ১৩.৪)

"এই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের তত্ত্ব ঋষিগণ নানাভাবে
নানা ছন্দে বর্ণনা করেছেন। ব্রহ্মসূত্রেও অসন্দিগ্ধ যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত সহকারে একে বর্ণনা করা হয়েছে।"
ভারতবর্ষে পূর্বে যতগুলি মত-পথ এবং দার্শনিক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে তার প্রত্যেকটি বেদান্তদর্শনের ভাষ্যের উপর ভিত্তি করে। প্রত্যেক আচার্য তাঁদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বেদান্তসূত্রের ভাষ্য রচনা করে। মানব সভ্যতায় বেদান্তের দান অপরিসীম। ভারতীয় দর্শনের এবং জাতীয় জীবনের মূলাধার বেদান্ত। বেদান্তের মূল তত্ত্বগুলি যেমন শঙ্কর, রামানুজ, নিম্বার্ক, বলদেবাদি সংস্কৃত ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত আচার্যবৃন্দকে পথ দেখিয়েছে; ঠিক তেমনি যুগপৎভাবে পথ দেখিয়েছেন, কবির, দাদু, রবিদাস, রামকৃষ্ণ, লালন ইত্যাদি মাটির খুব কাছাকাছি সন্তবৃন্দকে। বেদান্তের জ্ঞান কেউ পেয়েছে পুস্তকের মাধ্যমে, কেউ পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে। আবার কেউ হয়ত পেয়েছে অবরোহ পদ্ধতিতে। সাধু চরিত্রের মাধ্যমে বেদান্তরূপ পদ্ম তাঁদের হৃদয়ে এমনিতেই প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।যে সকল আচার্যবৃন্দের ভাষ্য বেদান্তদর্শনে শ্রেষ্ঠ বলে মান্যতা দেয়া হয়। তাঁরা হলেন:
১. শ্রীশঙ্করাচার্যের শারীরকভাষ্য, ৭ম শতাব্দী
২. শ্রীভাস্কচার্যের ভাস্করীয়ভাষ্য, ৯ম-১০ শতাব্দী
৩. শ্রীরামানুজাচার্যের শ্রীভাষ্য, ১১শ শতাব্দী
৪. শ্রীনিম্বার্কাচার্যের বেদান্তপারিজাতসৌরভ ভাষ্য, ১১শ শতাব্দী
৫. শ্রীমধ্বাচার্যের পূর্ণপ্রজ্ঞ বা তত্ত্ববিবেকভাষ্য, ১৩শ শতাব্দী
৬. শ্রীকণ্ঠাচার্যের শৈবভাষ্য, ১৩শ ১৪শ শতাব্দী
৭. শ্রীবল্লভাচার্যের অনুভাষ্য, ১৬শ শতাব্দী
৮. শ্রীবলদেবাচার্যের গোবিন্দভাষ্য, ১৮ শতাব্দী

 

ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বেদান্তের কোন মৌলিক ভাষ্য রচিত হয়নি। তবে বাঙ্গালী পণ্ডিত শ্রীপঞ্চানন তর্করতত্নকৃত ব্রহ্মসূত্রের শক্তিভাষ্য ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের জগতে একটি অনন্য ভাস্বর হয়ে আছে; এ শক্তিভাষ্যে আদ্যাশক্তিকেই ব্রহ্মরূপে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। পূর্ববর্তী ভারতবর্ষের আচার্যবৃন্দরা যত সম্প্রদায় প্রবর্তন করেছেন, সেই সকল সম্প্রদায়ই প্রবর্তিত হয়েছে বেদান্তের বিশেষ করে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনার মাধ্যমে। শ্রীশঙ্করাচার্যের বেদান্তদর্শনের ভাষ্য সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি বেদান্তদর্শনের শ্রুতি প্রস্থান (উপনিষদ), স্মৃতি প্রস্থান (শ্রীমদ্ভগবদগীতা) এবং ন্যায় প্রস্থান (ব্রহ্মসূত্র) -এ প্রস্থানত্রয়ীরই ভাষ্য লিখেছেন। শঙ্করাচার্যের রচিত অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি প্রকরণগ্রন্থ হল 'বিবেকচূড়ামণি'। এ গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ শ্লোকেই তিনি, বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ গোবিন্দকে আমি প্রণাম করেছেন। যে গোবিন্দকে সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জানা যায়।
সর্ববেদান্তসিদ্ধান্তগোচরং তমগোচরম্ ।
গোবিন্দং পরমানন্দং সদ্গুরুং প্রণতোঽস্ম্যহম্ ॥
(বিবেকচূড়ামণি:১)

"সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তে যাঁর কথা বলা হয়েছে, যিনি বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ সদ্ গুরু; সেই গোবিন্দকে আমি প্রণাম করি।"
শ্রীশঙ্করাচার্যের মত শ্রীচৈতন্যদেবও বেদান্তকে অবলম্বন করে তাঁর দার্শনিক চিন্তাকে স্থাপন করেছেন। শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত বেদান্তসূত্রকে ঈশ্বরের বচন বলে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, মানব, মহামানব, ঋষি, মুনি দেবতা—সকলের মনীষায় ভ্রম, প্রমাদ, করণাপাটব ও বিপ্রলিপ্সা এই চার প্রকার দোষ বা ত্রুটি বর্তমান। শুধু কম আর বেশি। তাই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তাদের সিদ্ধান্তে ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। শুধু ভুল নেই, পরমেশ্বরের বাণীতে। শ্রীব্যাসদেব ভগবানের চব্বিশ অবতাতের অন্যতম। তাই তাঁর সিদ্ধান্তে কোন ত্রুটি নেই।
"প্রভু কহে, বেদান্তসূত্র—ঈশ্বর-বচন।
ব্যাসরূপে কৈল তাহা শ্রীনারায়ণ৷৷
ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা, করণাপাটব।
ঈশ্বরের বাক্যে নাহি দোষ এই সব।।”
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: আদি, ৭.১০৬-১০৭)

অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, বর্তমানে সনাতন সম্প্রদায়ের যেসকল গুরুগণ বিশেষ করে বাংলায় তাদের নিজস্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্প্রদায় প্রবর্তন করছেন, তাদের জীবনে এবং সম্প্রদায়ের উপরে বেদ-বেদান্তের প্রভাব খুব একটা নেই বললেই চলে। এ ব্যক্তিকেন্দ্রিক মত-পথগুলির অপরিছন্ন অলিগলির সর্বনাশা পথের কারণেই আজ আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুজাতি বিভ্রান্ত হয়ে বেদ-বেদান্তের রাজপথ থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে চলে যাচ্ছি। তাই একমাত্র বেদ-বেদান্তের চর্চাই পারে- আমাদের সকল ক্ষুদ্রত্বকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমাদের সর্বজনীন, যুক্তিবাদী, বৈশ্বিক নাগরিক করে তুলতে। বেদান্ত সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের কয়েকটি হিরন্ময় উক্তি প্রণিধানযোগ্য:
"পৃথিবীর সকলেরই বেদান্তের চর্চা করা কেন উচিত, তাহার প্রথম কারণ এই যে, বেদান্তই একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম। দ্বিতীয় কারণ, জগতে যত শাস্ত্র আছে, তন্মধ্যে কেবল বেদান্তের উপদেশের সহিত বহিঃপ্রকৃতির বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে লব্ধ জ্ঞানের পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে। আধুনিক পাশ্চাত্য জাতিগণের পক্ষে ... বেদান্ত আলোচনার দ্বিতীয় হেতু- ইহার অদ্ভুত যুক্তিসিদ্ধতা।"
(স্বামী বিবেকানন্দ ২০১৫: ৫৬)

"ভারতেও প্রাচীন বা আধুনিক কালে নানা বিরোধী সম্প্রদায় বর্তমান থাকিলেও ইহাদের সবগুলি উপনিষদ্ বা বেদান্তরূপ একমাত্র প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত। তুমি দ্বৈতবাদী হও, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী হও, শুদ্ধাদ্বৈতবাদী হও, অথবা অন্য কোন প্রকারের অদ্বৈতবাদী বা দ্বৈতবাদী হও, অথবা তুমি যে-নামেই নিজেকে অভিহিত কর না কেন, তোমার শাস্ত্র উপনিষদ্‌ই প্রমাণস্বরূপ তোমার পিছনে রহিয়াছে। যদি ভারতের কোন সম্প্রদায় উপনিষদের প্রামাণ্য স্বীকার না করে, তবে সেই সম্প্রদায়কে ‘সনাতন’-মতাবলম্বী বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না। জৈন— বিশেষতঃ বৌদ্ধ মত উপনিষদের প্রামাণ্য স্বীকার করে নাই বলিয়া ভারতভূমি হইতে বিদূরিত হইয়াছিল; অতএব জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে বেদান্ত ভারতের সকল সম্প্রদায়ের একমাত্র উৎস। আমরা যাহাকে হিন্দুধর্ম বলি, সেই অনন্তশাখা -প্রশাখাবিশিষ্ট মহান অশ্বত্থবৃক্ষরূপ হিন্দুধর্ম বেদান্তের প্রভাব-দ্বারা সম্পূর্ণ অনুস্যূত। আমরা জানি বা নাই জানি— বেদান্তই আমাদের জীবন, বেদান্তই আমাদের প্রাণ, আমরণ আমরা বেদান্তের উপাসক; আর প্রত্যেক হিন্দু বেদান্তেরই সাধন করে।"
( বিবেকানন্দ ২০১৪: ১৭৬)

গ্রন্থ সহায়তা:
১.স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা (৫ম খণ্ড), উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: ৪র্থ সংস্করণ ২০১৫
২. ভারতে বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: আগস্ট ২০১৪

সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন