ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহান গণিত ও জ্যোতিবিজ্ঞানী আর্যভট্ট I

the great Indian Scholar Aryabhatta.

◕ পরিচয় 
আর্যভট্ট ছিলেন সেই মহান কয়েকজন ভারতীয়দের মধ্যে একজন, যাকে উনার অবদানের জন্য সারা পৃথিবী চিরকাল স্মরণ করবে। উনি গণিত, মহাকাশ নিয়ে গভীর চর্চা করেছিলেন।


◕ জন্ম 

তিনি ৪৭৬ খ্রীঃ জন্ম গ্রহণ করেন। ঐ সময় ভারতে গুপ্ত যুগের শাসন চলছিল(৩২০-৫৫০খ্রীঃ)। সম্রাট ছিলেন বুদ্বগুপ্ত (শাসন কাল ৪৭৬-৪৯৫ খ্রীঃ)। আর্যভট্ট ৫৫০ খ্রীঃ মৃত্যু বরন করেন। যেহেতু ঐ সময় সারা দেশে একটা যুগের পরিবর্তন হচ্ছিল, হয়তো সে কারণে আর্যভট্টের জন্মস্থান বা উনার দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে একেবারে সঠিক কোন তথ্য আমরা পাই না। হয়তো উনি লিখে গেছেন কিন্তু আমরা তা এখনো খুঁজে পাইনি, কিংবা তা কালে হারিয়ে গেছে। যেমন হারিয়ে গেছে উনার লেখা অর্ধ-রাত্রিকা (মধ্যরাত্রি)।যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে কেউ বলছেন উনার জন্মস্থান হচ্ছে প্রাচীন অস্মাকা। যা হয়তো মহারাষ্ট্র বা ঢাকাতে হতে পারে। কেউ বলছেন কুসুমপুরা, যা বর্তমানে পাটনা। কেউ বলছেন উনি প্রাচীন কেরালার কডুনগলুর এ জন্ম গ্রহণ করেন। তবে উনি কুসুমপুরাতে( বর্তমানে পাটনা) উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নাই।


◕ কর্মজীবন 
আর্যভট্ট ছিলেন কুসুমপুরাতে একটি বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ। যেহেতু নালন্দা ও কুসুমপুরা পাশাপাশিই ছিল তাই অনেকে মনে করেন যে উনি নালন্দার সাথে ও যুক্ত ছিলেন কারণ তখন নালন্দাতেও মহাকাশ বিজ্ঞান পড়ানো হত। পৃথিবীর বর্তুলতা ও আহ্নিক গতির কথা তিনিই প্রথম বলেন এবং তার গণিত দিয়ে প্রমাণ করেন। চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমরা সর্বপ্রথম উনার কাছ থেকেই পাই। যখন উনার বয়স মাত্র ২৩ বছর তখন উনার বিখ্যাত বই আর্যভটিয়া প্রকাশিত হয়। বইটি ছিল কবিতার ছন্দে। পরে ১৩ শতাব্দীতে এই বইটি ল্যাটিন ভাষাতে অনুবাদ করা হয়। এই বইটিতে আর্যভট্ট যা ব্যাখ্যা করেন তাইই পশ্চিমী বিজ্ঞানীরা প্রায় ১০০০ বছর পরে ব্যাখ্যা করেন। আমরা বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় যেহেতু পশ্চিমকেই অনুকরণ করি তাই আমরা পশ্চিমকেই বেশী জানি। তবে গ্রীকরা ঐ সময়ও আর্যভট্টকে খুব কদর করত এমন অনেক তথ্য পাওয়া যায়।




◕ আর্যভট্টের রচিত আর্যভটিয়া 
আর্যভটিয়া বইটিতে শুরুতে ১৩টি পঙক্তি ছিল ভূমিকা বিষয়ে। পরের ১০৮টি পঙক্তি ছিল বিজ্ঞান , গণিত, মহাকাশ নিয়ে। বইটিতে মোট চারটি অধ্যায় ছিল।



১ম অধ্যায়ঃ গিতিকপডা (Gitikapada)
এই অধ্যায়ে উনি সময়ের বিশাল একক নিয়ে আলোচনা করেন। যেমন কল্প, মনবন্ত্রা , যুগ ইত্যাদি।
কল্পঃ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে ৪৩২ কোটি বছরে ১ কল্প।
মনবন্ত্রাঃ এটি একটি যুগ্ম শব্দ। মনু এবং অন্তরা একত্রে মনবন্ত্রা। ইহা আসলে এক মনু রাজার জীবন কাল। ১৪ মনবন্ত্রা মিলে এক কল্প।
যুগঃ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে সত্যযুগ ১,৭২৮,০০০ বছর, ত্রেতা যুগ ১,২৯৬,০০০ বছর , দ্বাপর ৮৬৪,০০০ বছর আর কলি যুগ ৪৩২,০০০ বছর। বিন্দু বিন্দু সময় জমে এক মহাকাল তৈরী হয়েছে, ইহাই এই প্রথম অধ্যায়ের বিষয়। মহাকালকে পরিমাপ করার বর্ণনা এখানে পাওয়া যায়।


২য় অধ্যায়ঃ গনিতপডা (Ganitapada)
এই অধ্যায়ে আছে গণিত, পরিমাপ বিদ্যা, ভূগোল , গণিতের সূত্র ইত্যাদি।


৩য় অধ্যায়ঃ কালক্রিয়পডা (Kalakriyapada)
এই অধ্যায়ে সময়ের ক্ষুদ্র হিসাব নিয়ে ব্যাখ্যা আছে। যেমন দিন, সপ্তাহ, বছর ইত্যাদি।



৪র্থ অধ্যায়ঃ গোলপডা(Golapada)
এই অধ্যায়ে আছে গণিত, জ্যামিতি, গ্রহাদির কক্ষপথ, গ্রহণ , পৃথিবীর আকৃতি ইত্যাদির বর্ণনা।

◕ উনার মহান অবদান এবং কেন আমরা উনার কাছে ঋণী ?
ক) উনি আমাদের ০ (zero ) এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যদিও ইতিহাসে ভারতীয় মহান গণিতজ্ঞ ব্রহ্মগুপের (জীবনকাল ৫৯৮ – ৬৭০ খ্রীঃ) লেখা বই ব্রহ্মস্পুতসিদ্বান্তে (Brahmasphuṭasiddhanta) প্রথম শূন্যের লেখা পাওয়া যায় , অনেক গণিতজ্ঞ এবং ইতিহাসকার মনে করেন যে আর্যভট্ট উনার ২৩ বছর বয়সে যে বই প্রকাশ করেন তা ব্রহ্মগুপের জীবনকালের আগে আর সেই বইতে বর্ণিত গণিত সূত্র শূন্যের সুন্দর প্রয়োগ আছে।যদিও এটা ঠিক যে অতি প্রাচীন মুনি-ঋষিরা ও শূন্য সম্পর্কে জানতেন। তেমনি ব্যাবলীয়ান সভ্যতা ও শূন্য সম্পর্কে ধারনা রাখতেন।

খ ) আর্যভট্ট ৫ম শতকে পাই (Pie, π ) এর সঠিক মান নির্ধারণ করেন এবং তার সাহায্যে বৃত্ত, ত্রিভুজ এর মান বের করেন। মনে রাখতে হবে তার ১২০০ বছর পর ১৭০৬ খ্রীঃ গণিতবিদ উইলিয়াম জোন্স π এর মান ব্যবহার করেন আর তাকেই π এর জন্মদাতা বলা হয়। কিভাবে আর্যভট্ট ‘পাই’ এর মান বের করে ছিলেন বা বৃত্তের পরিধি মেপে ছিলেন? উনার সূত্র অনুসারে ১০০ এর সাথে ৪ যোগ কর। তাকে ৮ দিয়ে গুন কর। এর সাথে ৬২০০০ যোগ কর। এবার তাকে ২০০০০ দিয়ে ভাগ কর। যে সংখ্যা পাওয়া যাবে তার সাথে বৃত্তের ব্যাস গুন করলে সদাই বৃত্তের পরিধি পাওয়া যাবে। আর এই সংখ্যাটি হল ৩.১৪১৬। যা বর্তমানে ‘পাই’ এর মান। তেমনি তিনি ত্রিভুজ, বৃত্তের ক্ষেত্রফল বের করার সূত্র বর্ণনা করেন। যা আধুনিক বিজ্ঞান প্রায় ১০০০ বছর পরে বের করে।

গ ) মনে রাখতে হবে তিনি ঐ সময়ে নিজের সূত্র অনুসারে পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করে ছিলেন ২৪৮৩৫ মাইল। আধুনিক বিজ্ঞানে পৃথিবীর পরিধি ২৪৯০২ মাইল। অর্থাৎ আর্যভট্টের সংখ্যা থেকে মাত্র ৬৭ মাইল বেশী।

ঘ ) তিনি তাঁর সূত্রের সাহায্যে ৫ম শতকে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে পৃথিবী তার নিজ অক্ষের চারিদিকে ঘুরে এবং ৩৬৫ দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসে। এর প্রায় ৯০০ বছর পর বিখ্যাত নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) তার বইতে সেই কথা বর্ণনা করেন। কিন্তু শাসক এবং ধর্মগুরুদের ভয়ে তা প্রকাশ করেন নি। তিনি তা প্রকাশ করেন ঐ সময় যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়। তার পরবর্তী সময়ে মহান গ্যালেলিও (১৫৬৪-১৬৪২ খ্রীঃ) কোপারনিকাসের সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। শাসক ও ধর্মগুরুদের সিদ্ধান্ত ছিল উল্টা। ফলে উনাকে কারাগারে বন্দী করা হয় এবং তাকে তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন ভাবে সাজা দেওয়া হয়। তিনি তার সিদ্ধান্ত পাল্টান নি। শেষে তাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়।

ঙ ) আর্যভট্ট তার বইতে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে গ্রহরা সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়। সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণ শুধু আলো-ছায়ার খেলা।

চ ) তিনি তার সূত্র দ্বারা ব্যাখ্যা করেছিলেন যে গ্রহের কক্ষপথ হচ্ছে ডিম্বাকার। যা আধুনিক বিজ্ঞান অনেক পরে জানতে পারে।

ছ ) যখন ত্রিগোনমিতির নাম-গন্ধ ছিল না, তখন তিনি তার সূত্রের সাহায্যে sine, cos এর মান বের করেছিলেন। যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন অর্ধ-জ্যা(half-chord)। অনেক পরে আধুনিক বিজ্ঞানে ত্রিগোনমিতি আসে।

জ ) আজকেও আমরা যে পঞ্জিকা বা পঞ্চগ্রাম ব্যাবহার করি, তার সূত্র এবং সিদ্ধান্ত আর্যভট্টেরই দান। এমনকি ইরান এবং আফগানিস্তানের জাতীয় ক্যালেন্ডারে আজো আর্যভট্টের সূত্র ব্যবহৃত হয়।

ঝ) এছাড়া ও উনার অনেক সূত্র, সিদ্ধান্ত বর্তমান যুগে বিভিন্ন মহাকাশ অভিযানে ব্যবহৃত হয়।

ইতিহাসের এই মহান ভারতীয়কে সম্মান জানাতে ভারতের প্রথম উপগ্রহের নাম রাখা হয় আর্যভট্ট। বিহার সরকার উনাকে সম্মান জানাতে, পাটনাতে উনার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করেন ‘The Aryabhata Knowledge University (AKU)’. এই মহান ব্যক্তির অনেক লেখা আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তা না হলে আমরা হয়তো আরো অনেক রহস্য জানতে পারতাম।


By : riyabutu.com 
নবীনতর পূর্বতন