বাস্তু শাস্ত্র। আধুনিক স্থাপত্যবিজ্ঞানের মূল উৎস।

বাস্তু-শাস্ত্র-স্থাপত্যবিজ্ঞানের-মূল-উৎস।

বাস্তুবিদ্যা হলো এমন একটি বিষয়, যার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যউপাত্ত ব্যবহার করে বানানো বা সাজানো যে কোন স্থাপনা এনে দিতে পারে সুস্বাস্থ্য ও শুভফল। বাস্তুশাস্ত্র হলো এক সুপ্রাচীন স্থাপত্যবিষয়ক ফলিত ও কারিগরি বিদ্যা। এর ভিত্তি ছিলো সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক অবস্থা ও জলবায়ুতে।  সনাতন ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদের অংশবিশেষ হলো এই বাস্তুশাস্ত্র, যা ৪ হতে ৫ হাজার বছরের প্রাচীন। অথর্ব বেদের একটি অংশ হলো ‘স্থাপত্য বেদ’। এই স্থাপত্য বেদ থেকেই বাস্তুবিদ্যা বা স্থাপত্য বিজ্ঞানের অবতারণা। মূলত হিন্দু মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপত্যগুলো এই রীতিতে নির্মিত হলেও বিশাল প্রেক্ষাপটে তা গৃহনির্মাণেও ব্যবহৃত হতো। এই শাস্ত্রটি মূলত স্থপতি ঋষিদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আর তাদের শিষ্যদের তা অধ্যয়ন ও সংশোধনের অধিকার ছিলো। প্রতিটি সংশোধনের জন্য যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অত্যন্ত গভীর পর্যবেক্ষণ করে সর্বসম্মতভাবে সংশোধন করা হতো।


‘বাস্তু’ শব্দটি এসেছে ‘বস্তু’ থেকে। বস্তু মানে যেকোনো বস্তু। মূলত বাস্তু বলতে সব কিছুকেই বুঝায়। তা একটি স্থান হতে পারে কিংবা একটা বাড়িও হতে পারে। বাস্তুশাস্ত্রের নিয়মগুলো পড়লেই বোঝা যাবে, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে আমরা যদি আমাদের বাসস্থান বা কর্মস্থলের নকশা তৈরি করি, তা হলে সেখানকার বাসিন্দা বা কর্র্মীদের মধ্যে পারস্পরিক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং জীবন কাটবে সুখশান্তিতে।
বাস্তুর নিয়ম অথবা সিদ্ধান্তগুলোর পিছনে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। শুধু তাই নয়, এর পিছনেও রয়েছে বিজ্ঞান। পৃথিবীর ওপর সূর্যরশ্মির প্রভাব, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, বাতাসের গতি ও তার প্রভাব ইত্যাদি এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলোর ওপর সম্পূর্ণভাবে নজর দেয়া হয়েছে। ভোরের সূর্যরশ্মি মানুষের জীবনের পক্ষে অনেক উপকারী। কিন্তু সেই সূর্যের রশ্মিই মধ্যাহ্নের পরে অতটা উপকারী নয়, বরং ক্ষতিকারক।


বাস্তু জ্ঞানের প্রায়োগিক দিক :
পৃথিবী প্রতিনিয়ত উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে ঘুরছে। ঘূর্ণায়মান অবস্থায় উত্তর-পূর্ব দিকেই কাত হয়ে আছে। ভুমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশের সঙ্গে রয়েছে মানুষের সম্পর্ক। তাই আদিকাল থেকেই মানুষ বিচার-বিবেচনা করে ঠিক করেছিলো যে, পূর্ব এবং উত্তর দিকে এরকম কোনও কিছু নির্মাণ বা বৃক্ষরোপণও অনুচিত যার ফলে সূর্যকিরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে উত্তর দিকে ফাঁকা জায়গা রাখার অর্থ কী, কারণ সূর্যকিরণ তো পূর্ব দিক থেকে আসে।
সূর্য সারা বছর একই পথে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পরিক্রমণ করে না। একবার সে যায় উত্তরের পথে, আর একবার দক্ষিণপথে। প্রতি পথেই সে ছয়মাস ধরে নিয়মিত পরিক্রমণ করে। উত্তরের পথে পরিক্রমণ করে ২২ ডিসেম্বর থেকে ২১ জুন পর্যন্ত। এই সময়কে বলে সূর্যের উত্তরায়ণ। আবার দক্ষিণের পথে পরিক্রমণ কাল ২১ জুন থেকে ২২ ডিসেম্বর। এই সময়কে বলে সূর্যের দক্ষিণায়ন। কোনো একটি স্থাপনায় সূর্য রশ্মির সারাটা দিন থেকে শুরু করে সারা বছরের প্রভাব গভীর পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এই বাস্তু শাস্ত্রে। এমনকি মানুষের জীবনযাত্রায় সূর্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে অনেক সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে সেখানে।


বাস্তুশাস্ত্র ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি :
বাস্তুশাস্ত্র সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক এক ভাবনা। ‘দিক’ এবং ‘সৌরশক্তি’ ছাড়াও বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী গৃহনির্মাণ মহাজাগতিক রশ্মির কম্পনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের প্রাচীন মুনি-ঋষিরা এই বাস্তুশাস্ত্রের জনক। তাদের অতীন্দ্রিয় কল্পনাশক্তি এবং অন্তর্দর্শনের ফসলই হলো বাস্তু।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন