উপবাস কী এবং কেন ? জানুন পবিত্র বেদ ও শ্রীমদ্ভাগবত গীতার আলোকে।

উপবাস কী এবং কেন ? জানুন পবিত্র বেদ ও শ্রীমদ্ভাগবত গীতার আলোকে।


উপবাস করা মানে (ব্রত) করা ব্রত করা মানে (উপবাস) করা।
ব্রত/উপবাস পবিত্র বেদে ব্রত সম্পর্কে—

 “বয়ং সোম ব্রতে মনস্তনূষু বিভ্রতঃ।


  প্রজাবন্তঃ সচেমহি।।”

(ঋগ্বেদ, ১০/৫৭/৬)

শব্দার্থঃ- (সোম) হে সোমদেব (তনূষু) শরীরে (মনঃ) মনঃ শক্তিকে (বিভ্রতঃ) ধারণ করিয়া (বয়ম্) আমরা (তব ব্রতে) তোমার ব্রতে (প্রজাবন্তঃ) প্রজা সহিত (সচেমহব) তোমাকে সেবা করিতেছি।

অনুবাদঃ- হে প্রেমময় পরমাত্মান্! শরীরে মানসিক শক্তিকে ধারণ করিয়া আমার সন্তাদের সহিত তোমার ব্রতে তোমাকেই সেবা করিতেছি।

 “ব্রতেন দীক্ষামাপ্নোতি দীক্ষামাপ্নোতি দক্ষিণাম ।


 দক্ষিণা শ্রদ্ধামাপ্নোতি শ্রদ্ধয়া সত্যমাপাতে ।।”

     (যজুঃ ১৯/৩০)

“হে মনুষ্যগণ !  তোমরা মনুষ্য জন্মের উদ্দ্যেশ্য জানিয়া ব্রত ধারণ করিয়া সংসারে কর্ম্ম কর ; (মনুষ্য জীবনে পূর্ণ সফলতা ও শ্রেষ্ঠ উৎকর্ষ লাভের জন্য কর্ত্তব্য পালন করিবার সঙ্কল্পকে ব্রত কহে)।

ব্রত ধারণ করিয়া কর্ম্ম করিলে, পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য দক্ষিণাস্বরূপ তোমাদের দান করিয়া রাখিয়াছি  গ্রহণকরতঃ তাহার। সদোপযোগ করিয়া সুখী হও। ঐশ্বর্য্যে মোহপ্রাপ্ত না হইলে আমার উপর শ্রদ্ধা বাড়িতে থাকিবে, আমার উপর শ্রদ্ধা বাড়িলে আমাকে সত্যস্বরূপ ও আনন্দস্বরূপ জানিয়া ও প্রাপ্ত হইয়া মুক্তির আনন্দ ভোগ করিতে পারিবে।
    
মনুষ্য বলিতে গেলে জীব জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীব,  জ্ঞান গ্রহণের উপযোগী, কর্ম্ম করিতে স্বাধীন, চৈতন্য স্বরূপ জীবাত্মাকেই বুঝায়। জীবাত্মা, শরীর ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধি অহংকাররূপ করণ আদির সাহয্যে জ্ঞান, কর্ম্ম, উপাসনা রূপ সমস্ত প্রয়োজন সাধিত করিয়া থাকে, ইহারা মনুষ্যের ভৃত্য স্বরূপ। স্থূল শরীর, ইন্দ্রিয় করণ আদি সমস্তই জড় প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন বলিয়া ইহাদের ভোগের কোন প্রয়োজন থাকিতে পারে না। মনুষ্যের ব্রত বলিতে গেলে, আত্মার শ্রেষ্ঠ উৎকর্ষের উপযোগী কর্ত্তব্য কর্ম্ম করিবার সঙ্কল্প বুঝায়। মনুষ্য মাত্রেই দুঃখের নিবৃত্তি চায় ; সুখের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত মানুষের মধ্যে কোথা হইতে দুঃখ আসিল জানিতে না পারিলে তাহার নিবৃত্তির উপায় কি করিয়া স্থির হইতে পারে।

শ্রীমদ্ভগবদ গীতা (ধ্যানযোগ : ১৬-১৭)
অতিভোজী, নিতান্ত অনাহারী, অতি ঘুম বিলাসী, একেবারে কম ঘুমায় তারা কখনো ধ্যানে সফল হয় না। যিনি নিয়মানুযায়ী আহার করেন, কাজ করেন, বিশ্রাম নেন, যার নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মের ছন্দে ছন্দায়িত তিনি ধ্যানে সফল হন।তার দুঃখের বিনাশ ঘটে। বিচরণ করেন আত্মার আনন্দলোকে।

শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় (ধ্যানযোগ : ১৬-১৭) বলেছে কর্মের জন্য (ব্রত/উপবাস) করতে হয় কেন তা বিশ্লেষণ করে দিচ্ছি—
ভোগাসক্ত, আসুরী-সম্পদসম্পন্ন, সেইসব মানুষের মনোভাব কীরূপ, ভোগে আসক্ত এরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে, অহংকার এবং অর্থগর্বে গর্বিত হয়ে থাকে।
হ্যাঁ, এরা যজ্ঞাদি শুভকর্ম যা কিছু করে তা সবই দম্ভ ও লোকদেখানোর জন্য এবং অবিধিপূর্বক করে থাকে।

তারা কেন এমন করে?— (কেননা তারা অহংকার, দম্ভ, অভিমান, কাম ও ক্রোধের আশ্রয় নিয়ে থাকে)। ভগবান, তাদের আর কী ভাব হয়?— (এইসব ব্যক্তি তাদের ও অপরের দেহস্থিত অন্তর্যামীরূপ আমাকে দ্বেষ করে থাকে এবং আমার ও অপরের গুণাদিতে দোষদৃষ্টি রাখে)।।

উপবাস বলতে কী বোঝায় তা খুব সংক্ষেপে কিছু বলা যাক— (উপবাস মানে ঈশ্বরের নিকটে বাস)।

ব্রত (উপবাস) করবেন আপনি যজ্ঞ, তপস্যা ও দানেরও তিনপ্রকার পার্থক্যের কথা শুনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।

সাত্ত্বিক যজ্ঞ কী—
যজ্ঞ করা কর্তব্য— মনে এই ভাব নিশ্চিত করে ফলেচ্ছাবর্জিত ব্যক্তিগণ শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী যে যজ্ঞ করে থাকেন, তাকে বলে সাত্ত্বিক যজ্ঞ। (গীতা ১৭/১১)

রাজসিক যজ্ঞ কী—
হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন! যে যজ্ঞ ফলেচ্ছাসহ অর্থাৎ নিজ নিজ স্বার্থের জন্য করা হয় অথবা লোক দেকাবার উদ্দেশ্যে করা হয়, তাকে তুমি রাজসিক যজ্ঞ বলে জানবে। (গীতা ১৭/১২)

তামসিক যজ্ঞ কী—
যে যজ্ঞ শাস্ত্রবিধিবর্জিত, অন্ন-দানরহিত, মন্ত্রহীন, বিনা দক্ষিণায় অশ্রদ্ধা সহকারে করা হয়, তাকে তামসিক যজ্ঞ বলা হয়।। (গীতা ১৭/১৩)

উপবাস কী—
উপবাস মানে হলো সর্বেন্দ্রিয়ে সংযম সাধন। উপবাস মানে হলো অভীষ্ট দেবতা বা বিষয়ের প্রতি একাগ্রতা সাধন। মাঝে মাঝে উপবাস মানে হতে পারে দীর্ঘদিন অতি আহারের ফলে সঞ্চিত পেটের চর্বি ক্ষরণ।

উপবাসের আসল ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য হলো ভগবানে গুণ ও কর্মসমূহ নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটানোর কর্মসাধন। যাঁর জন্য অবাঞ্ছিত কর্মকে পরিহার করাই উপবাস। যেমন, গীতা শিক্ষা করতে গিয়ে অন্য সকল আহার বিহার চিন্তা কর্ম ত্যাগ করাই উপবাস। এককথায় উপবাসের সবচেয়ে বড় প্রকাশ হয় নির্লিপ্ত ভাবে ঐশ্বরিক সকল কার্য সুষ্টভাবে সম্পাদন করা। যাতে নিজের ও জগতের সার্বিক কল্যাণ হয়।

“উপবাস” শব্দের অর্থ— নিকটে বাস। “উপ” শব্দের অর্থ- নিকট, “বাস” শব্দের অর্থ অবস্থান করা। উপবাস শব্দের অর্থ নিকটে অবস্থান করা। অর্থাৎ, বাচিক ও মানসিক ভাবে কায়মনবাক্যে সংযম পালন পূর্বক ঈশ্বরের নিকট অবস্থান বা সান্নিধ্য গ্রহণ করার নাম “উপবাস”। উপবাস মানে কিন্তু না খেয়ে কঠোর কৃচ্ছতা পালন নয়। আর ঘন ঘন অনাহারী ব্যক্তির শরীর খারাপ ও দুর্বল হয়।

শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন—
"আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা-ই পরিবর্ত্তিত হতে হতে সারভাগ শুক্রে পরিনত হয়। শুক্র হল মস্তিষ্কের ভোজন। আর তা থেকেই জীবমনের চিত্তধাতু উৎপন্ন হয়। বিধিমত উপবাস করলে উদ্বৃত্ত শুক্র মনের হীন বৃত্তি গুলির উদ্রেক না করে মনকে উন্নততর বৃত্তির দিকে পরিচালিত করে। তা ছাড়া উপবাসের ফলে শরীরের অনাবশ্যক দূষিত পদার্থ গুলোও নষ্ট হয়ে যায়।

মহাভারত অনুশাসন পর্বে আছে—
"যে উপবাস করে সে সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী হয়।
সে রোগমুক্ত হয় ও শৌর্য-বীর্যে তেজস্বী বা তেজস্বিনী হয়।

চিন্তানায়াক বিবেকানন্দ বলেছেন—
‘সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়। কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’ কারণ সত্যকে আশ্রয় করে থাকলেই মানবিক গুণগুলি মনকে অবলম্বন করে থাকে। অন্যথায় দয়া, মায়া, মমতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ভালবাসা, ক্ষমা করার ইচ্ছা ইত্যাদি গুণগুলি ক্রমে ক্রমে সরে যায়।



"ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ।


জয় শ্রীরাম
হর হর মহাদেব
শ্রী বাবলু মালাকার
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

নবীনতর পূর্বতন