সৎ চিৎ ও আনন্দময় আত্মগুরুর সন্ধানে

গুরু কে, গুরু, আসল গুরু, গুরু প্রণাম মন্ত্র, গুরু চেনার উপায়, Guru

"যদিও মম গুরু শুড়ি বাড়ি যায়,
তবু মম গুরু নিত্যানন্দ রায়"

অর্থ:- আমার গুরু মদ ও বেশ্যাবাড়ি গেলেও আমার কাছে তিনি মহান নিত্যানন্দ তুল্য।

এ হলো এক অন্ধ গুরুভক্তিমূলক বঙ্গ বাক্য। লোকমুখে শোনা এই বাক্যটি হয়তো শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের। যাই হোক, এসব বাণীর অন্ধ অনুসরণেই সাধারণ জনগণ জীবনব্যাপী অসংখ্য ব্যক্তি, বাণী ও শক্তিকে যথাযোগ্য সম্মান ও গুরুত্ব দিয়েও কেবলমাত্র একটি সংক্ষিপ্ত বীজমন্ত্রদাতা ব্যক্তিগুরুকে নিয়ে নানা প্রকার দলাদলি ও জটিলতা সৃষ্টি করে থাকেন। তখন তারা তেমন অন্ধভাবে জানতে চান না গুরু, মন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক তত্ত্বজ্ঞান। কেবল কণ্ঠস্থ করা পদ্যছন্দে বলে যান, 

"গুরুনিন্দা যথা হয় তথা না যাইব
গুরু নিন্দুকের মুখ কভু না হেরিব"

ইত্যাদি আরো কত সুন্দর সুন্দর ব্যক্তিগত গুরুভেদ বাদে প্রেরণাদায়ী বৈষম্যমূলক পদ্য তা বলার অপেক্ষা থাকে না। এখন কথা হল, গুরুর দ্বারা আমরা যেখানে আত্মশক্তির সন্ধান ও বিকাশ সাধন করবো সেখানে গুরুর দ্বারা গুরুবাদ ও সামাজিক ভেদবৈষম্য বৃদ্ধি করে সমাজের সর্বনাশ হোক তা কি প্রকৃত গুরুগণ কখনো চাইতে পারেন?

আরো পড়ুন- খাঁচার মধ্যে ভগবান

এতে কোন বিবেকবান ব্যক্তি বা ভক্ত কখনো হ্যা বলতে পারবেন না। তাহলে কিভাবে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর বিষ রয়ে যায়? তা কি সত্যেকার কোন গুরুর দোষ? নিশ্চয়ই না। আমার জীবনের অসংখ্য অপরিহার্য ক্ষেত্রে উপযুক্ত পাত্রানুসারে জীবনের সকল সত্য রহস্য সহজ ও সুন্দর করে প্রকাশ করে দেন। যে গুরু যত বেশি প্রকাশ করতে পারেন তিনি তত বেশি ভক্তপ্রিয়। প্রকৃত যে গুরুগণ নিন্দা স্তুতি, মান অপমানে লিপ্ত নন,

তাদের কিসের নিন্দার ভয়?  একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্তের আলোকে বলা যাক্।

আমি সামান্য। আমার ক্ষুদ্র দৈহিক জীবনে মাতৃগর্ভে পেয়েছি মাতা ও পিতাগুরু এবং তাদের সংশ্লিষ্ট ডাক্তার সহ বহুজন। ভুমিষ্ঠ হতেই পেয়েছি ধাত্রী মাতা ও সহযোগী গুরুজন। যারা আমাকে কোলে নিয়ে গভীর স্নেহমমতায় সিক্ত হয়েছিল তারাও কি আমার গুরুত্ববহন করেনি?

নাকি প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আমার গুরু নন? ২০০৭ সালে ক্লাস সেভেন পড়াকালে আমাকে ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক গুরু বরণ করে নিয়েছিল। কারণ তখন আমার গুরুবরণের বুদ্ধিই পোক্ত হয়নি। তখন গুরুশ্রীমৎ স্বামী পূর্ণানন্দ পুরী মহারাজ তার ধ্যান মন্দিরে ফুলতুলসী মন্ত্রজলে ছোট্ট দুটি মন্ত্র সর্বদা জপ করতে বলেছেন। আজ পর্যন্ত সেই মন্ত্র শ্বাসেপ্রশ্বাসে স্থির রেখেছি।

আরো পড়ুন- আমাদের জীবনে বিবাহের গুরুত্ব

তাই বলে কি তিনিই আমার সর্বক্ষেত্রে সেরা বা বড় গুরু? কেমনে সম্ভব? আবার এখন আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যমে অন্তর্জাল জুড়ে আছে আমার নিত্য পথ প্রদর্শক জগদীশ বাসুদেব সদ্গুরু, স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দ, পরিব্রাজিকা মা দিব্যানন্দপ্রাণা, ড.করণম্ অরবিন্দ, স্বামী মুকুন্দানন্দ, জ্ঞানবৎসল স্বামী মহারাজ প্রমূখ মহান দিব্যসত্ত্বগুণী গুরুগণ।

ইতিমধ্যে অধিত বেদবিদ্যাসমূহের লেখক ও  প্রকাশকগণও আমার অন্তর্জগৎ জুড়ে নিত্য গুরুত্ব বিস্তার করে। এছাড়াও এর আগে ও পরে  আমাকে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য আমার জীবনের অসংখ্য অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তথা ঘরে বাইরে হাট বাজারে নাম জানা ও না জানা অসংখ্য ব্যক্তির শক্তি ও পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়েছিল। তাদের কখনো কোন মতেই আমার গুরুর তালিকা হতে বাদ দিতে পারি না। এখানে অনেকে টাকা নিয়ে আবার অনেকে টাকা ছাড়াই এই গুরুর স্থান দখল করে আছেন। 

তাহলে কে সেই গুরু যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্র দখল করে থাকবেন? 

তাই হলো মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। শুধু সাধারণ ক্ষেত্রে নয়, গোটা শাশ্বত ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রও সেই গুরুকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। যিনি ছাড়া সকল গুরুই গুরুত্বহীন। কে সেই সুন্দর কে?.......

সমগ্র বেদের চূড়ান্ত জ্ঞান তথা বেদান্ত যাকে প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম, তত্ত্বমসি, অহং ব্রহ্মাস্মি ইত্যাদি কতগুলো মহাবাক্যে প্রকাশ করেছে সেই আমিই বলতে পারি আমাকে আমার চির আন্তরিক চির অচেনা গুরু। যাকে চেনার জন্যই অন্যদের বিচিত্র সাহায্য আবশ্যক এবং  অন্যান্য ব্যক্তি, বস্তু বা শক্তিকে গুরু পদে বরণ করতে হয়।

এই সেই সুন্দর এই.....

যিনি সর্বব্যাপী যিনি সদা চেতনার মধ্যে অস্তিত্ববান তিনি সদেহে বা পরদেহে তিনি অন্ত পঞ্চভূতে বা বহির্পঞ্চভূতে সদা বিরাজমান। যাকে কেবল অনুভবের মাধ্যমেই আপন করতে হয় তিনিই আমাদের মধ্যে চিরস্থিত অচেনা গুরু। তাকে একবার চেনা হয়ে গেলে সকল গুরু সার্থক, সমগ্র জীবন ও জনম্ সার্থক। তখন অতি শ্রমে ও যতনে কাউকে আর আত্মীয় করতে হয় না।

তখন যারা এই একাত্মাকে চিনে বা চিনতে চান সকলে তখন অনায়াসে আত্মীয় হয়ে যান। সমস্থ জাত, গোত্র, লিঙ্গ, সম্প্রদায় বৈষম্য মানুষ ভুলতে বাদ্য হন। সমাজ হতে বাধ্যতামূলক সংস্কার ও আচারের বোঝা হালকা হয়ে পড়ে। সন্ত্রাস,দুর্নীতি তখন বিলুপ্ত হয়। সার্বিক ভাবে সমৃদ্ধ হয় জনপদ।

লোভ, লালসা জাত সমস্ত অত্যাচার ও শোষনমূলক আধিপত্য আর মাথা উচু করে দাপটে বেড়ায় না। নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা নিয়ন্তন করে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। তখনই এই আত্মাগুরুর প্রকৃত আনন্দস্বরূপ প্রকাশিত থাকে বিশ্বব্যাপী।

কলমে- শ্রী শিবানন্দ দেব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন