বলি কি এবং কেন ? বলি নিয়ে বিবেকের কথা

বলি কি এবং কেন, বলি নিয়ে বিবেকের কথা, পূজায় বলি, বলি, মনসা পূজার বলি, কালী পূজার বলি

জীবনের পথে আমরা যতদূর যাই দেখি বা ভুলি পদতলে অসংখ্য জীব হত্যা করে চলি। নিজ শরীরের সুরক্ষার খাতিরে অখংখ্য জীবাণুঘটিত রোগব্যাধি হতে মুক্ত থাকতেও আমরা বিচিত্র জীবাণুনাশক ঔষধ গ্রহণ করে থাকি। শুধু জীবের আকারের তারতম্যের উপর ভিত্তি করেই আমরা এর হত্যার পাপপূন্যের বিচার করে থাকি।

আরো পড়ুন- খাঁচার মধ্যে ভগবান

বলি বলি বা কোরবানি বলি প্রায়ই একে অপরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দোষ চর্চা করে চলি। প্রশ্ন করে থাকি যে, নিতান্ত প্রয়োজনে বা অজ্ঞাতসারে যা কিছু হত্যা করা হোক না কিন্তু পূজা বা আচার বিশ্বাসের নামে কেন নিরীহ প্রাণীকে চরম অত্যাচারপূর্বক বলি বা জবাই করা হয়! এসব প্রশ্নের উত্তর বহুভাবে বলা গেলেও মানুষের নিষ্ঠুর চাহিদা, ভক্তি বিশ্বাসের অন্ধতা ও ইচ্ছার স্বাধীনতাকেই প্রাধান্য দিতে হয়। 

বলি নিয়ে শাস্ত্র মন্থন করতে আগ্রহী নই। তাই বিবেক বিচারের দ্বারস্থ হই। এখানে শুধু বলি শব্দের কয়েকটি শাব্দিক অর্থই আলোকপাত করছি। বলি শব্দের অর্থ নিবেদন, আহুতি, যজ্ঞ, সমর্পন ইত্যাদি। অথচ পৃথিবীর কিছু কিছু স্থানে বলি বলতে কেবল কতিপয় পূজার নামে কোন দেবালয়ে বা ঘরে কোন দেবদেবীর নামে কোন প্রাণী হত্যা বা কিছু নৈবেদ্যকে নির্দেশ করা হয়।

আরো পড়ুন- হিন্দু পারিবারিক আইনে বিবাহ

যাতে যজ্ঞ, আহুতি, নিবেদন ইত্যাদি মহান শব্দ খুব ক্ষুদ্রভাবে গৃহীত হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক মুক্ত কর্ম অর্থেই যজ্ঞ বলা হয়েছে। জগত ও জীবনের মুক্তির লক্ষ্যে যা কিছুই করা হয় তার সবই যজ্ঞ। 

যজ্ঞার্থাৎ কর্মণো অন্যত্র লোকো অয়ং কর্মবন্ধনঃ। 
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গং সমাচর।।

প্রকৃত পক্ষে যা কিছুই চির মহান,  শাশ্বত ও পরম পূন্যময় তা কখনো কোন ক্ষুদ্র দেশ, কাল, আচার, সংস্কৃতিকে নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। তাকে অবশ্যই হতে হয় সার্বজনীন তথা বিশ্বজনীন। 

একই ভাবে বলি,পূজা, নিবেদন, সমর্পণ ইত্যাদি যজ্ঞ শব্দের সমার্থক শব্দগুলোকেও সার্বিক ও শাশ্বত ভাবে রূপায়িত ও মহিমান্বিত করতে হলে আমাদের অবশ্যই ক্ষুদ্র দেশ, কাল, জাতি, গোষ্ঠীর গণ্ডি হতে মুক্ত করতে হবে। নতুবা বলি বা কোরবানী বলতে কেবল ছাগল, গরু বা মুখরোচক প্রাণীদের নির্দিষ্ট দিন তারিখে স্ব স্ব সংস্কারানুযায়ী হত্যানুষ্ঠানকেই ধার্য ও সীমাবদ্ধ করতে হবে।

আরো পড়ুন- ধর্ম প্রচার- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনেকে গরু ছাগলের মাংসে উদর ভর্তি করেও বলি ও কোরবানির ভেদবৈষম্য ও দোষগুণ নিয়ে অসংখ্য প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে থাকেন। আবার অনেকে হত্যাকালে গরুছাগল মুরগী ইত্যাদির ছটফটানি স্বচক্ষে সহ্য করতে না পেরে জীবনভর ডাল ভাত শাক-সবজি ভোজনের ব্রত ধারণ করেন। আর প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানীরা উদ্ভিদ বা প্রাণী যা কিছুই ভোজন করুক না কেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও আত্মজ্ঞানী হয়ে করে থাকেন।

পূর্বোক্ত দুই প্রকার ব্যক্তি যাদের মধ্যে কেউ পৈশাচিক ভাবে পশুর ন্যায় পশুহত্যা ও ভোজন করেন আর কেউ তা মোটেও সহ্য করতে না পেরে লতাপাতা ভক্ষণ করেন। তাদের সহানুভূতি কামনার্থে আমাদের এই সব বাক্য রচনা। যারা জীবনের জন্য অপরিহার্য জীবহত্যার পক্ষে কোন যুক্তি চান অথচ খুঁজে না পেয়ে চির দুঃখে মজে থাকেন তাদের অবশ্যই প্রকৃতির দিকে একটু দৃষ্টিপাত করতে বিনীত  অনুরোধ জানাই।

তখন অসংখ্যই দেখতে পাবেন যে, জীবের বিচিত্র প্রকৃতি বা প্রকৃতির বিচিত্র জৈব প্রবৃত্তিই সমস্ত জীবজগতের জন্মদাতা ও হত্যাকারী। তখন পশুহত্যা পশুবলি বা কোরবানি নিয়ে অফুরন্ত তর্ক বিতর্ক সহসা সান্ত হয়। যুগের পর যুগ মানুষ এব্যাপারে অসংখ্য শাস্ত্র ও গ্রন্থ রচনা করে আসছেন। তবু সহজে মানুষের সাম্প্রদায়িক বৃত্তিজাত পরস্পরের প্রতি দোষদর্শী মনোভাব দূরীভূত হয় না।

বলির পাঁঠা ভোজীরা বলেন, দুধের গরু হত্যা মানুষ হত্যার মত মহা পাপ আর গরুভোজীরা বলেন, তোমরা পাঁঠাভোজীরাই তো নিজেরা ভোজন না করে আমাদের ভোজনের উপযুক্ত করে উচ্চদরে গরু বিক্রি করো। বস্তুতঃ গরু জবাই করা বা কষাইর হাতে গরু বিক্রি করাতে যে উল্লেখযোগ্য কোন তফাৎ নেই তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। তাহলে বলির মাংসভোজীদের পক্ষে গরুকোরবানির বিরুদ্ধতা বা কোরবানি দাতাদের পক্ষে বলির বিরুদ্ধতার কোন ভিত্তি থাকে? 

যে সম্প্রদায় নিজের অধিকারলব্ধ যা কিছু বলি বা জবাই করুক না কেন তাতে মর্মাহত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কেননা মানুষ পরধন অধিকার করতে গিয়ে যেখানে চরম নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা ও অমানবিকতার প্রমাণ দিচ্ছে সেখানে আন্ত সাম্প্রদায়িক বা অন্যসাম্প্রদায়িক দোষ চর্চার কোন অবকাশ নেই। সমাজ হতে পরস্বাপহরণ, সন্ত্রাস, ঘুষ, দূর্নীতি দূর করাই হোক মানুষের প্রত্যাশা।

যা কিছুই ভোজন বা গ্রহণ করে আমরা জীবীত থাকি তারই প্রতি আমাদের আন্তরিক ভাবে ঋণী থাকা উচিৎ। হই হুল্লোড় করে বা পরম আনন্দ বিলাসে নীরিহ পশুর জৈবিক কষ্ট উপভোগ করা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের শোভা পায় না। আত্মদর্শনেই রয়েছে মানব জীবনের সার্থকতা। আত্মদর্শী মাত্রেই জগতের সকল ব্যক্তি, প্রাণী ও বস্তুর দেহকে নিজদেহবৎ আপন জ্ঞান করে থাকেন। বস্তুত চরম ক্ষুদ্রমনা, দেহসর্বস্ব, স্বার্থপর, ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও মোহগ্রস্ত লোকেরাই দেহের অপরিহার্য জ্বালানি তথা খাদ্য নিয়ে এত উল্লাস বিলাস করতে পারেন।

আমাদের শরীরের প্রতি যেমন আমাদের খুব আদর স্নেহ ও  মায়া মমতা রয়েছে তেমনি সকল প্রাণীরও রয়েছে একথা কোন পশু বুঝতে না পারলেও মানুষের বুঝা আবশ্যক। প্রয়োজনে পশুহত্যা করতে হলেও তার প্রতি দয়া, সহানুভূতি ও করুণাশীল হওয়াতেই রয়েছে পশু ও মানুষ উভয়ের চির বাঞ্ছিত মুক্তি। সকল মানুষই এই মুক্তি লাভ করুক। 

মুক্তচিন্তাশীল মানুষের মুক্তদৃষ্টির সংস্পর্শে এসে সকল প্রাণী ও বস্তুও মুক্তি লাভ করুক। ধন্য হোক সকল শাশ্বত সনাতন চেতনা।

‌( বি:দ্র: কোরবানী শব্দকে বলি শব্দের মতো উদার ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে যেন কোন সাম্প্রদায়িক আঁতে ঘা না লাগে। )

কলমে- শিবানন্দ দেব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন