চতুর্মঠ ও দশনামী সম্প্রদায়

দশনামী সম্প্রদায়, চতুর্মঠ, দশনামী সম্প্রদায় কি কি, ভগবান শংকরাচার্য, শংকরাচার্য

উত্তর মীমাংসা দর্শন অন্তর্গত বেদান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত অদ্বৈত মতবাদকে যিনি সুপ্রসিদ্ধ করেছেন সেই ভগবান শংকরাচার্য ভারতবর্ষে সনাতন ধর্মকেও সুসংগঠিত এবং পুনঃপ্রচার করার ক্ষেত্রে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। তৎকালীন সনাতন ধর্মানুসারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংঘর্ষিক ও পরষ্পরের বিরোধী বিদ্বেষী সম্প্রদায়কে একসূত্রে গেঁথেছিলেন আদি শংকরাচার্য।

পুণ্যক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত স্থান এর চয়ন করে ভারতবর্ষের চার প্রান্তে চারটি মঠ নির্মাণ করেন। দ্বারকায় শারদা মঠ, পুরীতে গোবর্ধন মঠ, বদরিনারায়ণ ধামে জ্যোতির্মঠ, রামেশ্বরে শৃঙ্গেরী মঠ।

এই চার মঠে চারজন প্রধান মঠাধিশ ( শংকরাচার্য ) নিযুক্ত করলেন। যদিও শংকরাচার্য এর অদ্বৈত বেদান্ত মতের অধিকাংশ শিষ্যই শৈব তবে শংকরাচার্য সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে দশনামী শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে তার প্রতিষ্ঠিত চারটি মঠের অধীনে নিয়ে এলেন। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের নামসমূহের তাৎপর্য্যঃ-

১.'গিরি'-

বাসো গিরিবনে নিত্যং গীতাধ্যয়নতৎপরঃ ।

গংভীরাচলবুদ্ধিশ্চ গিরিনামা স উচ্যতে ॥-(জ্যোতির্মঠাম্নায়- ৬)

অর্থাৎ যিনি পার্ব্বত্য বনে বাস করেন, সর্ব্বদা গীতাপাঠে নিরত, গম্ভীর ও স্থিরবুদ্ধি, তাঁহার নাম 'গিরি'।

২.'পর্ব্বত'-

বসন্ পর্বতমূলেষু প্রৌঢং জ্ঞানং বিভর্তি যঃ ।

সারাসারং বিজানাতি পর্বতঃ পরিকীর্ত্যতে ॥-(জ্যোতির্মঠাম্নায়- ৭)

অর্থাৎ যিনি পর্ব্বতমূলে বাস করিয়া দৃঢ়জ্ঞান ধারণ করেন, যিনি সার (নিত্য) ও অসার (অনিত্য) বিষয় জানেন, তাহাকে 'পর্ব্বত' বলিয়া অভিহিত করা হয়।

৩.'সাগর'-

তৎবসাগরগম্ভীর জ্ঞানরত্নপরিগ্রহঃ ।

মর্যাদাং বৈ ন লঙ্ঘ্যেত সাগরঃ পরিকীর্ত্যতে ॥ -(জ্যোতির্মঠাম্নায়- ৮)

অর্থাৎ যিনি তত্ত্ববিষয়ে সাগরবৎ গম্ভীর, যিনি জ্ঞানরূপ রত্নের ধারণ করেন এবং শাস্ত্রমর্যাদা লঙ্ঘন করেন না, তিনি 'সাগর' বলিয়া কথিত হন।

৪.'সরস্বতী'-

স্বরজ্ঞানরতো নিত্যং স্বরবাদী কবীশ্বরঃ ।

সংসারসাগরাসারহন্তাঽসৌ হি সরস্বতী ॥-(শৃঙ্গেরীমঠাম্নায়- ৬)

অর্থাৎ যিনি সর্ব্বদা বেদের স্বরজ্ঞানে রত, স্বরোচ্চারণে নিপূণ ও কবিশ্রেষ্ঠ এবং অসার সংসার সাগরের হন্তা তাঁহার নাম 'সরস্বতী'।

৫.'ভারতী'-

বিদ্যাভরেণ সম্পূর্ণঃ সর্বভারং পরিত্যজন্ ।

দুঃখভারং ন জানাতি ভারতী পরিকীর্ত্যতে ॥-(শৃঙ্গেরীমঠাম্নায়- ৭)

অর্থাৎ যিনি সকল ভার পরিত্যাগ করিয়া বিদ্যাভারের দ্বারা পরিপূর্ণ, এজন্য দুঃখভারকে জানেন না, তাঁহাকে 'ভারতী' বলা হয়।

৬.'পুরী'-

জ্ঞানতত্ত্বেন সম্পূর্ণঃ পূর্ণতত্ত্বপদে স্থিতঃ ।

পরব্রহ্মরতো নিত্যং পুরীনামা স উচ্যতে ॥-(শৃঙ্গেরীমঠাম্নায়- ৮)

অর্থাৎ যিনি জ্ঞানতত্ত্বের দ্বারা পরিপূর্ণ, যিনি পরিপূর্ণতত্ত্বে অবস্থিত, সর্ব্বদা পরব্রহ্মে নিরত, তাঁহার নাম 'পুরী'।

৭.'তীর্থ'-

ত্রিবেণীসঙ্গমে তীর্থে তত্ত্বমস্যাদিলক্ষণে ।

স্নায়াত্তত্ত্বার্থভাবেন তীর্থনাম্না স উচ্যতে ॥ ৬॥-(শারদামঠাম্নায়- ৬)

অর্থাৎ যিনি তত্ত্বমস্যাদিরূপ ত্রিবেণীসঙ্গমতীর্থে তত্ত্বার্থভাবে স্নান অর্থাৎ তত্ত্বমস্যাদিপ্রতিপাদ্য বস্তু অবগত আছেন, তাঁহাকে 'তীর্থ' বলা হয়।

৮. 'আশ্রম'-

আশ্রমগ্রহণে প্রৌঢ় আশাপাশবিবর্জিতঃ ।

যাতায়াতবিনির্মুক্ত এতদাশ্রমলক্ষণম্  ॥ ৭॥-(শারদামঠাম্নায়- ৭)

অর্থাৎ যিনি সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণে নিপূণ, যিনি আশারূপ বন্ধনশূন্য, ও সংসারের গতাগতি বিরহিত, তাঁহাকে 'আশ্রম' বলা হয়।

৯. 'বন'-

সুরম্যে নির্জনে স্থানে বনে বাসং করোতি যঃ ।

আশাবন্ধবিনর্মুক্তো বননামা স উচ্যতে ॥ (গোবর্দ্ধনমঠাম্নায়- ৫-৬)

অর্থাৎ যিনি অতি রমণীয় নির্জ্জনস্থানরূপ বনে বাস করেন, যিনি সমস্ত আশাবন্ধন হইতে নির্ম্মুক্ত হন, তিনি 'বন' নামে কথিত হইয়া থাকেন।

১০. 'অরণ্য'-

অরণ্যে সংস্থিতো নিত্যমানন্দে নন্দনে বনে ।

ত্যক্ত্বা সর্বমিদং বিশ্বমারণ্যং পরিকীর্ত্যতে ॥- (গোবর্দ্ধনমঠাম্নায়- ৬-৭)

অর্থাৎ যাঁহারা এই সমুদায় বিশ্ব পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্বদা আনন্দময় নন্দনবন সদৃশ অরণ্যে বাস করেন, তাঁহাদিগকে 'অরণ্য' বলা হইয়া থাকে।

কলমে- শ্রী শুভ চৌধুরী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন