শত্রু মোকাবেলায় শাস্ত্রীয় বিধান | শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

শত্রু মোকাবেলায় শাস্ত্রীয় বিধান | শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রথম অধ্যায়েই 'আততায়ী' শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। আমাদের ধর্মশাস্ত্রে আততায়ী ঘৃণ্য এবং নৃশংস হওয়ার কারণে, সে শাস্তির যোগ্য। স্মৃতি শাস্ত্রেও আততায়ীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তাদের প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে। বশিষ্ঠ সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ে আততায়ী সম্পর্কে বলা হয়েছে:

অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ। 
ক্ষেত্রদারহরশ্চৈব ষড়েত আততায়িনঃ।।

"যে ঘরে আগুন দেয়; খাবারে বিষ প্রয়োগ করে; ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করতে উদ্যত হয় বা করে; অন্যের ধনসম্পদ যে জোর করে অপহরণ করে; অন্যের ক্ষেতখামার বা জমিজমা যে দখল করে এবং ঘরের স্ত্রীদের অপহরণকারী; এছয় প্রকার দুষ্কৃতিকারীকে আততায়ী বলা হয়।"

এই আততায়ীরা হয়ত সাময়িক শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছে; কিন্তু তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তারা অপরাজেয় নয়। ইচ্ছা, একাগ্রতা এবং নিরবচ্ছিন্নতা থাকলে তাদের আজ হোক বা কাল হোক পরাজিত করা যায়। ইচ্ছাটাই মুখ্য। কারণ সদিচ্ছার একটি দৈবশক্তি আছে। তা আমরা অনেকেই জানিনা বা জানিনা বলে উপলব্ধিও করতে পারিনা। একজন দুর্জন আততায়ীরূপ শত্রু আজ হয়ত অপরিসীম শক্তিশালী ; কিন্তু আজীবন তারা কখনো শক্তিশালী থাকতে পারে না। আজ হয়ত শক্তিশালী শত্রুর চোখের দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছে; কিন্তু সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারলে এ আততায়ীই একদিন ভূলুণ্ঠিত হবে, পদদলিত হবে। নৌকার মাঝি যেমন নদীর জলের মনভাবকে উপলব্ধি করে এগিয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই পরিস্থিতির গন্ধ আমাদের আগের থেকে আঁচ করে করে আমাদের জীবনের নৌকা বয়ে চলতে হবে। তারাহুরো করে বিপদকে ডেকে নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। কোন বিষয়ে যত বেশী দ্রুত সময়ে করতে যাব, ততই বিষয়টি অস্বাভাবিক হয়ে বিপদ ঘটার শতাংশ বেড়ে যাবে। মঙ্গলময় কল্যাণকর কাজ রয়ে সয়ে ধীরেসুস্থে করতে হয়। কাজটা মঙ্গলমত সম্পন্ন করাটাই মুখ্য।

যারা ঘরে আগুন দেয়; খাবারে বিষ প্রয়োগ করে; ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে; অন্যের ধনসম্পদ জোর করে অপহরণ করে; অন্যের জমিজমা যে দখল করে এবং স্ত্রীদের অপহরণকারী; শাস্ত্রে উক্ত এছয় প্রকার আততায়ীকে প্রতিরোধ করতে হলে কৌশলের অবলম্বন করতে হবে। কৌশলের অবলম্বন না করলে এ দুরাচারী দুষ্কৃতকারীদের নিরস্ত্র করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে যায়।যতদিন অনুকূল সময় না আসে ততদিন পর্যন্ত শত্রুর সাথে সাময়িক সদ্ব্যবহার করে যেতে হবে। যদি প্রয়োজন পরে তবে আততায়ীরূপ শত্রুকে কাঁধে করে শত্রুকে বহন করতে হবে। কিন্তু যখন অনুকূল পরিবেশ আসবে, তখনই শত্রুকে ছুড়ে ফেলে সমূলে বিনাশ করতে হবে। তখন আততায়ীরূপ শত্রুকে কোন দয়া করা অধর্ম। বিষয়টি মহাভারতের আদিপর্বে সুস্পষ্টভাবে একটি কলসীর উদাহরণসহ বলা হয়েছে।

বহেদমিত্রং স্কন্ধেন যাবৎ কালস্য পর্যয়ঃ।
ততঃ প্রত্যাগতে কালে ভিদ্যাদঘটমিবাশ্মনঃ।।
(মহাভারত :আদিপর্ব, ১৩৫.২১)

"যতদিন পর্যন্ত কালের পরিবর্তন না হয়,ততদিন পর্যন্ত কাঁধে করে শত্রুকে বহন করবে। পরবর্তীতে যখন অনুকূল পরিবেশ আসবে, তখন পাথরের উপর কলসীকে ছুড়ে ফেলে দিলে যেমন কলসী ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ; তেমনিভাবে শত্রুকেও বিধ্বস্ত করবে।"

শত্রুকে দমনে হতাশার কিছুই নেই। মনে রাখতে হবে- রাত যত গভীর হয়, প্রভাত ততই কাছে আসে। এ জগতটা স্বপ্নের নয়, প্রতিক্ষণ এক এক রূঢ় বাস্তবতার জাল ঘিরে থাকে আমাদের। আমি চাই বা না চাই, এ রূঢ় বাস্তবতা জাল আমাদের ঘিরে ধরবেই। যতই আমরা নিজের মতই থাকতে চাই, আশেপাশের অন্যার আমাদের গায়ের উপরে চলে আসবেই। তাই এর থেকে উত্তরণের উপায় হল, আমাদের শত্রুকে সরাসরি বা কৌশলে মোকাবিলা করা। অন্যায়কারী দুরাচারী পাপিদেরকে কৌশল দ্বারা পরাভূত করা হলে, সেক্ষেত্রে কোন পাপ আশ্রয় করে না। কৌশলকে ধর্মদৃষ্টিতে আপাত অনেক সময় অধর্ম মনে হলেও, সময়ের প্রয়োজনে সেই অধর্মই স্বয়ং ধর্ম। শাস্ত্রে একে 'আপদধর্ম' বলা হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সর্বদা নিজেদের খেয়াল খুশি মত করেই আমরা জগতে চলতে পারব না। পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেই আমাদের চলতে হবে। সকল কাকের দেশে, আমরা ময়ূর সাঁজ সেঁজে বেশীক্ষণ বাঁচতে পারব না। তবে আশেপাশের কাকেরা হিংসা চরিতার্থ করতে এসে, ঠুকরে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়ে যাবে। কাকের দেশে কাক হয়েই বাঁচতে হবে এবং ময়ূরের দেশে ময়ূর হয়েই বাঁচতে হবে। বিষয়টি অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরী। এ কারণেই আমাদের শাস্ত্রে বলা আছে, "যস্মিন দেশে যদাচারঃ।"

দেশ পরিস্থিতি যেমন, তেমন ভাবেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে এবং সাধ্যমত আততায়ীদের সাথে লড়ে যেতে হবে। ক্ষমা বীরের ধর্ম। সকলেই ক্ষমা করতে পারে না। যদি কারো ঘরে আগুন দেয়, খাবারে বিষ প্রয়োগ করে, ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করে, ধনসম্পদ লুটপাট করে, জমিজমা দখল করে, স্ত্রীদের অপহরণ করে - এ সকল কর্মকাণ্ডের পরেও একজন ভীরু কাপুরুষ যদি  দুষ্কর্মকৃত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেয়; তবে সেই ক্ষমাকে ক্ষমা বলে না। হীনবীর্যতা বলে, অধর্ম বলে। ইদানীং আমরা অনেকেই দেখি দুষ্কৃতকারীদের  সকল অমানবিক কর্মকাণ্ডের পরেও আমরা প্রতিরোধ তো করিই না; উল্টো তাদের সাথে তেলবাজি এবং পদলেহন করতে শুরু করে দেই।  নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে, সব ভাগ্য এবং গোবিন্দের উপরে ছেড়ে দেই। মনে করি, নির্যাতিত হচ্ছি, নিপিড়ীত হচ্ছি, আমি লুণ্ঠিত হচ্ছি, সকলই গোবিন্দের ইচ্ছা। অন্যে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি করে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে সেটাও, তারই ইচ্ছে। আমি  মনে করি আমাদের কিছুই করার নেই, আসলে বিষয়টি তা নয়। আমরা ভুলে যাই আমি যদি প্রতিরোধ না করি, জেগে না উঠি তবে গোবিন্দও আমাকে কৃপা করবেন না। ভগবান তাকেই সাহায্য করেন, যিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে জেগে উঠেন।

আরো পড়ুন- প্রকৃত গুরু কে জানুন।

দুষ্কৃতকারী আততায়ীদের বিরুদ্ধে সকল কিছুই আমাদের করার আছে, শুধু প্রয়োজন একাগ্র ইচ্ছা। আমি এবং আমরা করবো এবং করতে পারবো- এ মনভাবটা অত্যন্ত জরুরী। সর্বদা মনে রাখতে হবে, জগতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। দুষ্কর্ম যাদের স্বভাবে, রক্তে এবং বংশে মিশে আছে আমি চাই বা না চাই, তারা অকারণ আমার গায়ের উপরে আসবেই। আমার ক্ষতি করবেই। ক্ষতি করতে চাইবেই; কারণ এটা তাদের রক্তের স্বভাব, বংশের স্বভাব।  অহেতুক নিরপরাধ মানুষের গায়ের উপরে এসে, তাদের ক্ষতির সম্মুখীন করাটা তাদের আমরা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু যদি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করি, তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ সহ নিশ্চিহ্ন করাও সম্ভব। গলা চুলকানো বুনোকচুগাছ কাউকে লাগাতে হয় না, এমনিতেই বনে-বাদাড়ে জন্ম নেয়। এক্ষেত্রে গলা চুলকানো বুনো কচুদের ও চাইলে খাওয়া যায়, যদি আমাদের সংগ্রহে ভাল বাঘাতেঁতুল থাকে। বুনো কচুদের ঠিক করতে বাঘাতেঁতুল অনস্বীকার্য এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই অস্তিত্বের সংকটে মাঝেমধ্যে আমাদের বাঘাতেঁতুল মহৌষধও প্রয়োগ করা অত্যন্ত  প্রয়োজন। 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন