বঙ্গসংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্র | শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

বঙ্গসংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, শ্রীরামচন্দ্র

বঙ্গের সাথে শ্রীরামচন্দ্রের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শ্রীরামচন্দ্রের পিতা রাজা দশরথের রাজত্বের মধ্যেই ছিলো বঙ্গদেশ। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে, রাজা দশরথ রাণী কৈকেয়ীকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত  সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বঙ্গদেশের  নামোল্লেখ করে ইচ্ছামত বর প্রার্থনা করতে বলেছেন।

যাবদাবর্ততে চক্রং তাবতী বসুন্ধরা৷৷
দ্রাবিড়াঃ সিন্ধুসৌবীরাঃ সৌরাষ্ট্রা দক্ষিণাপথাঃ। 
বঙ্গাঙ্গমগধা মৎস্যাঃ সমৃদ্ধাঃ কাশিকোসলাঃ৷৷ 
তত্র জাতং বহু দ্রব্যং ধনধান্যমজাবিকম্। 
ততো বৃণীষ্ব কৈকেয়ি যদ্ যৎ ত্বং মনসেচ্ছসি৷৷
(রামায়ণ: অযোধ্যা, ১০.৩৬-৩৮)

"দ্রাবিড়দেশ, সিন্ধু-সৌবীর দেশ, সৌরাষ্ট্র, দক্ষিণাপথ, বঙ্গদেশ, অঙ্গদেশ, মগধ ও মৎস্যদেশ, কাশি, কোশল – এই সকল সমৃদ্ধ দেশ, যতদূর পর্যন্ত সৌরচক্র আবর্তিত হচ্ছে ততদূর পর্যন্ত এই বসুন্ধরা আমার অধীন ; সেই সকল স্থানে জাত ধন-ধান্য, ছাগ-মেষ, সকলই আমার অধীনে। হে কৌকেয়ি! তুমি মনে মনে যা ইচ্ছা কর, তা আমার থেকে চেয়ে নাও।"

বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র ভগবান শ্রীরাম এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁদের কর্মের বর্ণনা বর্ণিত হয়েছে, পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য রামায়ণ মহাভারতে। এ গ্রন্থদুটিতে ভারতবর্ষে চিরকালের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীনেশচন্দ্র সেন রচিত 'রামায়ণী কথা'র পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভূমিকায় অত্যন্ত সুন্দর করে বলেছেন:

"রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে—রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্ম্যের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান।"

বাংলার পাল শাসনামলের একজন খ্যাতিমান কবি হলেন সন্ধ্যাকর নন্দী  (আনু. ১০৮৪-১১৫৫) । তিনি আনুমানিক একাদশ শতাব্দীতে 'রামচরিতম্' নামে একটি মহাকাব্য রচনা করেন।  সন্ধ্যাকর নন্দী উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমিতে পুন্ড্রবর্ধন নগরের নিকটস্থ বৃহদ্বটু গ্রামে এক কায়স্থ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন পালরাজ রামপালের (আনু. ১০৮২-১১২৪) একজন মন্ত্রী (সান্ধিবিগ্রহিক)। সন্ধ্যাকর নিজে রাজা মদনপালের (আনু. ১১৪৩-১১৬২) পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।সংস্কৃত ভাষায় রচিত এটি একটি দ্ব্যর্থবোধক কাব্য। অর্থাৎ প্রত্যেকটি শ্লোকের দুটি করে অর্থ প্রদান করে। চারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এ কাব্যে একই সঙ্গে দশরথপুত্র রামচন্দ্রের এবং গৌড়েশ্বর রামপালের চরিতকথা বর্ণিত হয়েছে। জীবনচরিতমূলক ঐতিহাসিক কাব্য হিসেবে গণ্য হলেও  'রামচরিতম্' গ্রন্থটিই কোন বাঙালির লেখা সম্ভবত প্রথম রামচরিতকথা।

বাঙালির জীবনে শ্রীরামচন্দ্রের প্রভাব অপরিসীম। মধ্যযুগের বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য নিদর্শন হলো মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের জীবনী, কৃত্তিবাসী রামায়ণ। গ্রন্থটি লিখেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁর সময়কাল হলো আনুমানিক ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৬১ খ্রিস্টাব্দ। রামায়ণ শুধু বঙ্গে নয় সারা ভারববর্ষের লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্যঅঙ্গ। ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি জাতি তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুসারে রামায়ণকে গ্রহণ করেছে। যেমন বাংলায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়লে মনে হবে, শ্রীরামচন্দ্র বুঝি বাঙালি ছিলেন। কৃত্তিবাস যখন রামায়ণ লিখেছেন, তখন বাঙালি সংস্কৃতির উপরে রামকে প্রতিস্থাপন করেছেন। তাই তো কৃত্তিবাসী রামায়ণ আজও প্রত্যকটি ঘরে ঘরে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, কিছু বছর পূর্বেও ঘরের বয়োবৃদ্ধগণ বিকালের অবসরে ঘরের সবাইকে নিয়ে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাঠ করতেন। ঘরের সকলেই সেই পাঠ শুনতো। বর্তমানে হয় নাগরিক জীবনে আধুনিকতার নামে আমরা পূর্বের সেই স্নিগ্ধ ঐতিহ্যগুলো দিনেদিনে হারিয়ে ফেলছি। ঘরের বৃদ্ধ দিদিমা, ঠাকুমাদের রামায়ণ পাঠের বিষয়টি আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাতেও পাই, তাঁর ‘আকাশ প্রদীপ’ কাব্যের ‘যাত্রাপথ’ কবিতায়। 

"কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা,
দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা।
আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগী তাহার মলাট
দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট।
মায়ের ঘরের চৌকাঠেতে বারান্দার এক কোণে
দিন-ফুরানো ক্ষীণ আলোতে পড়েছি এক মনে।
অনেক কথা হয়নি তখন বোঝা,
যেটুকু তার বুঝেছিলাম মোট কথাটা সোজাঃ—
ভালোমন্দে লড়াই অনিঃশেষ,
প্রকাগু তার ভালবাসা, প্রচণ্ড তার দ্বেষ।
বিপরীতের মল্লযুদ্ধ ইতিহাসের রূপ
সামনে এল, রইনু বসে চুপ।"

বঙ্গদেশে অসংখ্য খ্যাতিমান মানুষের নামের মাঝেই শ্রীরামচন্দ্র বিরাজিত।বৌদ্ধরাজা রামপাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগে সাধক রামপ্রসাদ বর্তমানকালে রামকৃষ্ণ ; আজও বাঙালির নামকরণে রামনামের জয়জয়কার। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি সংস্কৃতি বহুদূরে এগিয়ে যায় তাদের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের পরমহংসদেব প্রধানতম। তাঁর পিতৃপুরুষের উপাস্য শ্রীরামচন্দ্র। পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় পিতামহ মানিকরাম চট্টোপাধ্যায়ের নামের সাথেও রাম শবটি রয়েছে। তাঁরা তাঁদের ইষ্ট রঘুবীরের রামের পূজা দিয়ে, তবেই জল গ্রহণ করতেন। মানিকরাম সহ তাঁর বংশের প্রায় সকলের নামের মধ্যে রামচন্দের নাম সংযুক্ত। মানিকরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীরামকৃষ্ণের পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অন্যান্য ভাইবোনের নাম নিধিরাম চট্টোপাধ্যায়, কানাইরাম চট্টোপাধ্যায় এবং বোনের নান রামশীলা। সারদাদেবী এবং রাণী রাসমণির কূলদেবতাও রঘুবীর রামচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বাঙালি সাহিত্যিকেরা শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী স্বদেশীদের কাছে মাতৃভূমি স্বাধীন করে এক আদর্শিক রাজ্যের স্বপ্ন ছিল; সে স্বপ্ন হল রামরাজ্যের স্বপ্ন। হৃদয়ের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং ভালবাসা দিয়ে যদি আমরা ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের শরণাগত হতে পারি; তবে তিনিও আমাদের একান্ত আপনজন হয়ে অভয় দান করবেন। এ প্রতিশ্রুতি তিনিই আমাদের দিয়েছেন।

সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি চ যাচতে।
অভয়ং সর্বভুতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম।।
(রামায়ণ:যুদ্ধকাণ্ড, ১৮.৩৩)

"কেউ যদি শরণাগত হয়ে একবার মাত্র বলে আমি তোমার, তবে আমি তাকে অভয় দান করি। এই আমার ব্রত।"

ষোড়শ শতকের সুবিখ্যার বাঙালি অদ্বৈত বৈদান্তিক সন্ন্যাসী মধুসূদন সরস্বতী অকপট ভাবেই ভগবান বিষ্ণু এবং তাঁর অবতার শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণকে জ্ঞেয় পরমতত্ত্বরূপে স্বীকার করেছেন। তাঁর শ্রীমদ্ভগবদগীতার টীকাগ্রন্থের নাম 'গূঢ়ার্থদীপিকা'। এ গূঢ়ার্থদীপিকা গ্রন্থটি বাঙালির রচিত প্রথম শ্রীমদ্ভগবদগীতার টীকাগ্রন্থ। এ গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ শ্লোকেই  তিনি ভগবান শ্রীনারায়ণ এবং তাঁর অবতার শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা করেছেন। ভক্তজনের মানস যাঁর নিবাসস্থল, সেই ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে তিনি নমস্কার করেছেন। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র যে বহুপূর্ব থেকেই বঙ্গের পণ্ডিতসহ সকলের আরাধ্যদেবতা ছিলেন; মধুসূদন সরস্বতীর শ্রীমদ্ভগবদগীতার গূঢ়ার্থদীপিকা টীকাগ্রন্থের শুরুতে শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা এর বড় দৃষ্টান্ত। 

ওঁ নমো নারায়ণায়।
ওঁ নমঃ পরমহংসাস্বাদিতচরণকমলচিন্মকরন্দায় ডক্তজনমানসনিবাসায় শ্রীরামচন্দ্রায়।।

"ওঁ নমো নারায়ণায়। পরমহংসগণ যাঁর চরণকমলের চিৎমকরন্দ অর্থাৎ জ্ঞানমধু আস্বাদন করেছেন, ভক্তজনের মানস যাঁর নিবাসস্থল, সেই শ্রীরামচন্দ্রকে নমস্কার করি।"

বাল্মিকী রামায়ণে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রসঙ্গটির সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও মহাভাগবত এবং কালিকা পুরাণ সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজার প্রসঙ্গটি রয়েছে। বাঙালির শারদীয় দুর্গোৎসবের অকালবোধনের সাথেও জড়িয়ে আছে শ্রীরামচন্দ্রের নাম। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালীর উপাস্য শ্রীরাম। বাল্মিকী রামায়ণে না থাকলেও শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায় কৃত্তিবাস ওঝার লেখা কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণে। এই রামায়ণটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম রামায়ণ গ্রন্থ। বাঙালি ধর্ম, সমাজ এবং সংস্কৃতির সাথে এই গ্রন্থটির একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে তিনজন খ্যাতিমান মহিলা কবিকে পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামতারা বা রামী, শ্রীচৈতন্যদেবের পার্ষদ মাধবী এবং কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতী হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি এবং মহিলা হিসেবে প্রথম বাংলা ভাষায় রামায়ণের রচয়িতা। কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার পাতুয়ারী গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।তাঁর পিতা ছিলেন মনসামঙ্গলের রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাস এবং মায়ের নাম সুলোচনা। 

বাঙালির লোকবিশ্বাস এবং লোক বিস্বাসে ভূত-পেত্নীকে তাড়াতে শ্রীরামের নাম করা হয়। বিশ্বাস যে শ্রীরাম নাম শুনলে ভূত-পেত্নীরা ভয়ে পালিয়ে যায়। ভূত-পেত্নীরা শ্রীরামনাম সহ্য করতে পারে না। 

"ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি;
রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে করবি আমায় কি? "

মুখে সর্বদা যেন রামনাম করতে পারি তাই আমরা ভালো-মন্দ সকল পরস্পরবিরুদ্ধ শব্দের সাথেই রাম শব্দটি ব্যবহার করি। রামময় বাঙালির প্রত্যেকটি মন্দিরে সন্ধ্যায় যে নামকীর্তন করা হয় তাতেও রাম নাম। এই নামকীর্তনের মধ্যে বর্তমানকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলো ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরের সংস্কৃত ভাষায় লিখিত "হরে কৃষ্ণ" শ্লোকটি। এই অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং পবিত্র শ্লোকটির শুরুতেই, "হরে রাম"। তবে বঙ্গদেশে বর্তমানে শ্লোকটি কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায়। বঙ্গদেশে প্রথম লাইন "হরে রাম" স্থলে  দ্বিতীয় লাইন "হরে কৃষ্ণ" প্রথম লাইন হিসেবে পরিদৃষ্ট হয়।

"হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।।"

রামময় বাঙালির জীবন। আজও কোন বিস্ময়ের বা দুঃখের ঘটনায় আমরা বলি, হে রাম, হায় রাম ইত্যাদি। এমনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বাঙালি কাউকে গালি দিলেও রামনাম। কেউ বোকামি করলে আমরা বলি, 'বোকারাম' অথবা 'হাদারাম'। আবার কেউ যদি তার নিজের কাজটি ঠিকঠাক করতে না পারে তবে বাঙালির মুখে একটি শব্দ আঠার মত লেগে থাকে; শব্দটি হলো 'রামছাগল'। অর্থাৎ রামময় বাঙালির জগত। ঈশ্বরের উপাসনা থেকে লৌকিক জীবনের গালগালি সর্বত্রই শ্রীরামের উপস্থিতি। কোন অনাকাঙ্ক্ষিত নিন্দনীয় বা লজ্জাজনক কিছু দেখলে বাঙালিরা বলে, "এ্যা রাম"। "হে রাম" শব্দটিই লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে  এ্যা রাম হয়েছে। কোন ক্ষমতাবান বা সম্পদশালী ব্যক্তিকে বোঝাতে বলি 'রাঘববোয়াল'। জেনে বা না জেনে রামনামের বলয়েই ঘুরছে বাঙালি। 

বাঙালিরা আজও ঘরে আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটলে, আগুন লাগলে শ্রীরামের নাম করে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে এবং প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্জায় শ্রীরামচন্দ্রের নাম জপ করে। কারণ রামরাজ্যে বা শ্রীরামের শরণে যে থাকে, তার জীবনে সামান্যতম  কোন দৈবদুর্বিপাক ঘটে না। বিষয়টি রামায়ণের আদিকাণ্ডেও বর্ণিত হয়েছে:

ন চাগ্নিজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপ্সু মজ্জন্তি জন্তবঃ।
ন বাতজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপি জ্বরকৃতং তথা।।
(রামায়ণ : আদিকাণ্ড, ১.৯২)

"রামরাজ্যে কোন প্রাণীরই অগ্নি ভয়, জলে ডুবে যাওয়ার ভয় এবং প্রবল ঝড়-ঝঞ্জার ভয় থাকবে না, এমনকি জ্বরের ভয়ও থাকবে না।"

রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বলা হয়েছে, রামায়ণ শ্রবণে আয়ু বৃদ্ধি হয়, সৌভাগ্য বৃদ্ধি হয় এবং পাপ নাশ হয়। তাই  শ্রাদ্ধবাসরে সবাইকে রামায়ণ পাঠ করে শোনাতে হয়। 

ইদমাখ্যানমায়ুষ্যং সৌভাগ্যং পাপনাশনম্ ।
রামায়ণং বেদসমং শ্রাদ্ধেষু শ্রাবয়েদ্ বুধঃ ॥ 
অপুত্রো লভতে পুত্রমধনো লভতে ধনম্।
সর্বপাপৈঃ প্ৰমুচ্যেত পাদমপ্যস্য যঃ পঠেৎ৷৷
পাপান্যপি চ যঃ কুৰ্যাদহন্যহনি মানবঃ।
পঠত্যেকমপি শ্লোকং পাপাৎ স পরিমুচ্যতে৷৷ 
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড,১১১.৪-৬)

"এ রামায়ণ কাব্য আয়ু এবং সৌভাগ্যবৃদ্ধি করে এবং পাপ বিনাশ করে। রামায়ণ বেদের সমকক্ষ, বিদ্বান পুরুষদের শ্রাদ্ধে অবশ্যই রামায়ণ পাঠ করে শোনানো উচিত। 

রামায়ণ পাঠ করলে পুত্রহীন পুত্র এবং ধনহীন ধন লাভ করেন। যিনি প্রতিদিন এর শ্লোকের একটি পংক্তিও পাঠ করেন, তিনি সর্ব পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে যান। 

যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাপ কর্মে রত, তিনিও যদি এর একটি শ্লোক নিত্য পাঠ করেন, তবে তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়ে যান।"

রামায়ণের সেই নির্দেশনার দৃষ্টান্ত  আজও, পশ্চিমবঙ্গ,  বাংলাদেশ, ঝাড়খণ্ড আসাম, এবং ত্রিপুরা সহ সমগ্র বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে পাওয়া যায়।এ সকল অঞ্চলে কেউ মৃত্যুবরণ করলে  শ্রাদ্ধবাসরে বা শ্রাদ্ধকে উপলক্ষ করে রাত্রে  রামায়ণ গান করা হয়। তবে দক্ষিণবাংলা একরকম শ্রাদ্ধে রামায়ণগাণ বাধ্যতামূলক বলা চলে। একজন মুখ্য গায়ক থাকে এবং এর  সহযোগী  থাকে তার পাঁচসাত জন। কেই গায়ককে যন্ত্রে সহযোগিতা করে আবার অনেকে ধ্রুবপদ গাও। এই ধ্রুবপদকে গ্রাম্যভাষায় 'ধুয়া টানা' বলে। এ রামায়ণ গান বাঙালি লোকসংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রামায়ণের প্রভাব আজও জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতিতে।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন