আজ থেকে ৫২০০ বছর পূর্বে এই ভূখণ্ডে জন্মে ছিলেন এক যোগেশ্বর, সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ, পরমেশ্বরের অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। অবতাররূপে তিনি একজন আর্দশ নেতা, রাজনীতিক, রাষ্ট্রজ্ঞ, ধর্মসংস্থাপক এবং মুক্তিদাতা।
ধর্মরাজ্য সংস্থাপক শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বহুগ্রন্থে বহু রকমের কথা বলে তার জীবনকে পৌরাণিক, অলৌকিক ও কিছুটা অবিশ্বাস্য করে তোলা হয়েছে।ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনী প্রধানত তিনটি গ্রন্থে পাওয়া যায় :
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবন যাকে আমরা ধর্মসংস্থাপন বলি, সেই ধর্মসংস্থাপনের কথা পূর্ণাঙ্গভাবে আছে মহাভারতে।
- তাঁর যদুবংশের সকল কথা এবং ঘটনাবলী পাওয়া যায় মহাভারতের খিলকাণ্ড হরিবংশে।
- এবং তাঁর বাল্যকাল থেকে তিরোধান বা অবতার লীলা সম্বরণ পর্যন্ত সকল কথা আছে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে।
ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, বায়ুপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, কূর্মপুরাণ, বামনপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সহ একাধিক পুরাণে বড় পরিসরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কিত কথা পাওয়া যায়।এমনকি বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকেও একাধিক স্থানে, কিছু কিছু স্থানে বিকৃতভাবেও শ্রীকৃষ্ণের কথা পাওয়া যায়। তবে পুরাণগুলির মধ্যে পদ্ম এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এ দু'টি পুরাণের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না।বর্তমানে পদ্ম এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ নামে যে দু'টিগ্রন্থ পাওয়া তা অনেকটাই প্রক্ষিপ্ত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। ভাল করে গ্রন্থদুটো পাঠ করলে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, গ্রন্থদ্বয়ের মধ্যে সংযোজন বিয়োজনের ফলে প্রক্ষিপ্ত বিষয়টি।
ব্রহ্মপুরাণ এবং বিষ্ণুপুরাণ নামক এ দুটি পুরাণে বিস্তৃতভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা বর্ণিত আছে।বৈষ্ণব মতের অন্যতম ভিত্তি হলো শ্রীমদ্ভাগবত এবং বিষ্ণু পুরাণ নামক গ্রন্থদ্বয় । এর মধ্যে রূপে, রসে, মাধুর্যে আমাদের আঠারোটা পুরাণের মধ্যে অনন্য অসাধারণ হল শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। এ পুরাণটি জীবের সকল মালিন্য নাশ করে দেয়, তাই তাঁর আরেক নাম অমল পুরাণ। দ্বাদশ স্কন্ধে বিভক্ত ৩৩৫ টি অধ্যায় সম্বলিত প্রায় ১৮০০০ শ্লোকের সমন্বয়ে এ পুরাণ। প্রধানত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিত, অবতারতত্ব ও শ্রীকৃষ্ণরূপী পরমাত্মা বিষ্ণুর মাহাত্ম্য আলোচিত হলেও পুরাণের পঞ্চ লক্ষণসমন্বিত সকল প্রকার উপাদান এ গ্রন্থের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অসাধারণ তার ধ্বনিমাধুর্য এবং পদলালিত্য। শ্রীমদ্ভাগবতের বিশেষ বার্তা হল:
- অচিন্ত্য ভগবান সর্বত্র আছেন।
- তিনি জীবের কল্যাণে অবতাররূপে আসেন।
- তিনি তাঁর সন্তানদের কাছে ডাকেন,ভালবাসেন এবং রক্ষা করেন সকল বিপদ থেকে।
- তিনি হলেন ভাবনার মধ্যে ভাবনাতীত।
- তিনি পরম সুন্দরতম এবং শ্রবণমঙ্গলময় তাঁর বাক্য।
আজ আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যময় রূপ নয়, বৈরাগ্যমময় রূপ নয়, তাঁর ধর্ম সংস্থাপন রূপ নয়, তাঁর পুরুষোত্তম রূপও নয় ; তাঁর শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বরিক মাধুর্য রূপকে, আমাদের মনুষ্য অথবা মনুষ্যেতর পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রতিনিয়ত অপমান করে চলছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মনুষ্যকৃত প্রেমিক সাজিয়ে আমরা অসংখ্য কাব্য,নাটক, সিনেমা এবং যাত্রাপালা করে চলছি। কিছু মানুষের সৃষ্টির নামে অপসৃষ্টি দেখলে মনে হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বুঝিবা নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালারই চেংড়া নায়ক!তাই বাধ্য হয়ে বলতেই হয়, যেদিন থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাত্রাপালার নায়ক হয়েছে সেদিন থেকেই হিন্দুদের কপাল পুড়েছে।
জীবনব্যাপী চরম রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও জগতের অশেষ কল্যাণ চিন্তা করে তিনি সেই সময়ের সকল কল্যাণকামী রাজাদের একত্রিত করেছিলেন। এমনই স্বার্থহীন ছিলেন যে রাজ্য জয় করেও নিজে কখনো ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। হাজার হাজার নিপীড়িত নারীর আর্তধ্বনি ছিলো নরকাসুরের কারাগারে, সেই নারীদের মুক্তি দিয়ে তিনি নারী মুক্তির পথও উন্মোচন করেছিলেন। প্রায় দশবছর বয়সেই তিনি বৃন্দাবন থেকে মথুরায় চলে যান। এরপর আর কখনোই তিনি বৃন্দাবনে আসেননি।‘ভগ’ শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য বা শক্তি। বিষ্ণু পুরাণে ভগবানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে:
“সমগ্র ঐশ্বর্য্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র সৌন্দর্যরূপ শ্রী, সমগ্র জ্ঞান এবং সমগ্র বৈরাগ্য এই ছয়টি মহাশক্তিকে একত্রে বলে ‘ভগ’ । এ সকল অচিন্ত্য মহাশক্তি যাঁর মধ্যে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে বিদ্যমান, তিনিই ভগবান ।”
ঐশ্বর্যাদি ছয় মহাশক্তিসম্পন্ন সচ্চিদানন্দ বিগ্রহই ভগবান ।ঐশ্বর্য অর্থে সর্ববশীকারিতা, যে শক্তিতে কেবল ঈশ্বরের ভাব প্রকাশিত হয় । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতার লীলায় সম্পূর্ণভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি পূর্ণ ঐশ্বর্যসম্পন্ন অচিন্ত্য পুরুষোত্তম ভগবান ।
তিনি জীবরূপে প্রাণিগণের দেহ এবং ব্রহ্মরূপে জগৎ ব্যাপ্ত করে রয়েছেন। অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ; এই জন্য তিনি ‘পুরুষোত্তম’। তিনি সমস্ত কার্যের ও সমস্ত কারণের উৎপত্তি ও বিনাশের হেতু। তিনি সর্বদাই সমগ্র জগৎ জানছেন বলে মুনিরা তাঁকে ‘সর্ব’ বলে থাকেন। কৃষ্ণ সত্যে প্রতিষ্ঠিত আছেন, সত্যও তাঁতে প্রতিষ্ঠিত আছে এবং তিনি খণ্ড সত্য অপেক্ষা পূর্ণ সত্য; এই জন্য ‘সত্য’ তাঁর আর এক নাম। আর তিনি বিক্রম প্রকাশ করেন বলে ‘বিষ্ণু’।"
তিনি সর্বাকর্ষক পরম পুরুষ।তিনি জীবকে তাঁর দিকে আকর্ষিত করে আনন্দ এবং মুক্তি প্রদান করেন; তাই তাঁর নাম ‘ শ্রীকৃষ্ণ’।
"কৃষ্ ধাতুর অর্থ সত্তা এবং ‘ণ’ শব্দের অর্থ আনন্দ; এই উভয়ই তাঁতে আছে বলে যদুবংশীয় কৃষ্ণ ‘কৃষ্ণ’ নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।"
বৃহত্তর ভারতর্ষের সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল তিনি। তাই এই অঞ্চলের সংগীত, নৃত্যসহ কলাবিদ্যার প্রায় সকল কিছুই তার জীবনককে অবলম্বন করে রূপায়িত। এমনকি বাংলা ভাষাও বিকশিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীকে অবলম্বন করে। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কবি জ্ঞানদাস, কবি গোবিন্দদাস থেকে আধুনিক যুগে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ সবাই 'কানহার' প্রেমে মাতোয়ারা ছিল। বৈষ্ণব পদাবলী রীতিতে ব্রজবুলি ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'। বাংলা এবং মৈথেলী ভাষার সংমিশ্রণে এ পদাবলীর ভাষা অনন্য। কয়েকটি পঙক্তির দৃষ্টান্ত দেয়া যায়: